ধন্যবাদের দেশে

>

রূপবৈচিত্র্যে জাপানের একেকটা জায়গা একেক রকম। কিন্তু বিনয়, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা, ভদ্রতায় প্রত্যেক জাপানি যেন এক সুতোয় গাঁথা।
রূপবৈচিত্র্যে জাপানের একেকটা জায়গা একেক রকম। কিন্তু বিনয়, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা, ভদ্রতায় প্রত্যেক জাপানি যেন এক সুতোয় গাঁথা।

রূপবৈচিত্র্যে জাপানের একেকটা জায়গা একেক রকম। কিন্তু বিনয়, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা, ভদ্রতায় প্রত্যেক জাপানি যেন এক সুতোয় গাঁথা।

জাপানে বেড়াতে যাব—এটা জানার পর থেকেই বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন মা। দেশের জামালপুর গেলেই চিন্তায় তাঁর ঘুম হয় না, আর এ তো জাপান! কী খাব, ঠান্ডায় টিকতে পারব কি না—এমন নানা বিষয় নিয়ে তাঁর চিন্তা! অবশ্য মাকে দোষও দেওয়া যায় না। শুরুতেই তাঁর চিন্তার একটা খোরাক জোগালাম। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথেই আবিষ্কার করলাম, ক্যামেরার চার্জার ঠিকই নিয়েছি, কিন্তু ক্যামেরাই নেওয়া হয়নি। আর জাপান ভ্রমণের তৃতীয় দিনই প্রমাণ পেলাম আমাকে নিয়ে চিন্তার যথেষ্ট কারণ আছে!

এনোশিমার বাতিঘর
এনোশিমার বাতিঘর

মুগ্ধতার শুরু

জাপানে বাস থেকে নামার সময় টিকিট দেখাতে হয় চালককে। টিকিট দেখে সন্তুষ্ট হয়ে রোবটের মতো মাথা নিচু করে ধন্যবাদ দেবেন যাত্রীকে। যাত্রী নেমে গেলেই বন্ধ হয়ে যাবে স্বয়ংক্রিয় দরজা, সঙ্গে সঙ্গে আবার ছুটবে বাস। টিকিট দেখিয়ে নেমে গেলাম। বাস চলে যেতেই মনে পড়ল, এই বাসেই আমার সবকিছু। অর্থাৎ মানিব্যাগ। একবার মনে হলো, বাংলা সিনেমার নায়কের মতো বাসের পেছনে ছুটি। তবে মাথা গরম করলাম না (ডিসেম্বরে জাপানে তীব্র শীত, মাথা গরম করার সুযোগই নেই)। জাপানি বন্ধু শিমা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে দেখে বললাম, ‘মনে হয় মানিব্যাগ বাসে ফেলে এসেছি।’

একটা বিস্ময়সূচক প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে সে বলল, ‘কী ছিল মানিব্যাগে?’

‘সব ডলার। আইডি কার্ড।’

ছুটলাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। বাসের সময়সূচি লেখা বোর্ড থেকে কেন্দ্রীয় বাস অফিসে ফোন দিল শিমা। বাস অফিস কয়েকটা প্রশ্ন করল। কী রঙের মানিব্যাগ, কোন সিটে বসেছিলাম ইত্যাদি। তারপর বলল, ‘আমরা পেলে জানাব।’ পেলে জানাব—এই কথা সম্পর্কে ভালোই ধারণা আছে। তাই হাল ছেড়ে দিয়ে হোস্টেলে ফিরে এলাম। হোস্টেলের অভ্যর্থনাকারী শুনে চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হওয়ারই কথা, মানিব্যাগ না পেলে বিলটা দেব কীভাবে?

ঠিক ১০ মিনিটের মাথায় ফোন এল। বাস অফিস থেকে একজন ফোনে জানালেন, ‘নিকটস্থ চকোকুনোমোরি স্টেশনে এসো। তোমার মানিব্যাগ নিয়ে বাস আসছে।’

দ্রুত স্টেশনে গেলাম। সত্যি সত্যি একটা যাত্রীশূন্য বাস এসে থামল। দরজা খুলে চালক আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন মানিব্যাগ এবং আমি কিছু বলার আগেই ধন্যবাদ দিয়ে চলে গেলেন।

বলা যায় তখন থেকেই জাপানের প্রতি মুগ্ধতার শুরু। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, চাকচিক্যের চেয়েও জাপানিদের নম্র-ভদ্র ব্যবহার, শৃঙ্খলাই বেশি মুগ্ধ করেছে আমাকে। জাপানে কাটানো আট দিনে যতবার ধন্যবাদ বা ‘আরিগাতো গোজাইমাস’ শুনেছি, জীবনে অতগুলো কলাও বোধ হয় খাইনি!

আশি হ্রদ
আশি হ্রদ

১৪ হাজার মানুষের শহরে

হাকোনে নামের একটা শহরে গিয়েছিলাম। রাজধানী টোকিও থেকে কিছুটা দূরের এই শহরে প্রায় ১৪ হাজার মানুষের বসবাস। ফুজি পর্বত, শিন্তো ধর্মের মন্দির, আশি হ্রদ, গোরা পার্ক, জাপানের প্রথম উন্মুক্ত জাদুঘর, কাচের জাদুঘরসহ বিভিন্ন ধরনের জাদুঘর দেখতে প্রচুর পর্যটক ভিড় করেন হাকোনেতে। আগ্নেয়গিরি থাকায় ঐতিহ্যবাহী হট স্প্রিংয়ের জন্যও বিখ্যাত এই শহরটা।

জাপানিজ অ্যানিমেতে যেমন পাহাড়ঘেরা ছোট্ট, ছিমছাম শহর দেখা যায়, হাকোনে ঠিক তেমনই। হাকোনে নামটার অর্থ জানতে না পেরে নিজেই একটা অর্থ দাঁড় করিয়ে ফেললাম। ট্রেন থেকে নেমে বিস্ময়ে হাঁ করে এক কোণে দাঁড়িয়ে থাকা যায় বলেই বোধ হয় এর নাম হাকোনে। মনে হলো সিনেমার কোনো সেটে ঢুকে পড়েছি। একটু পরপর যাওয়া–আসা করছে ছোট ছোট রঙিন ট্রেন। যাত্রীরা উঠছে চকচকে কিন্তু পুরোনো আমলের গাড়িতে। এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে বহু পুরোনো টানা রিকশা। স্টেশন ঘিরেই ছোট্ট একটা বাজার। সারি সারি দোকানে খাবার, স্মারক সাজিয়ে রাখা। দোকানি হাসিমুখে আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন সবাইকে।

পর্যটন শহর হলেও অসম্ভব রকমের নীরবতা হাকোনেতে। নীরবতার চিত্র আসলে পুরো জাপানেই। সবাই খুব মৃদু স্বরে কথা বলে। বাস-ট্রেনে তো ফোনে কথা বলাই নিষেধ। যত প্রয়োজনই হোক, বাস-ট্রেনে ফোনে কথা বলা যাবে না। কারণ, অন্য যাত্রীরা বিরক্ত হতে পারেন। একই চিত্র হাকোনেতেও। সন্ধ্যা ৬টার পর সব সুনসান।

হাকোনের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ফুজি পর্বত। কুয়াশা, বৃষ্টি আর মেঘের কারণে এক দিনও ভালোভাবে দেখতে পারিনি তার আসল রূপ। ফুজি দেখার জন্য নানা ব্যবস্থা করেছে শহর কর্তৃপক্ষ। দুই পাহাড়ের মাঝখানে তৈরি ৪০০ মিটার লম্বা ঝুলন্ত সেতু মিশিমা স্কাইওয়াক থেকে কিংবা আশি হ্রদে জাহাজে চেপে বা রোপওয়ে, কেব্​ল কারে চড়ে দেখা যায় ১২ হাজার ৩৮৯ মিটার উঁচু এই পর্বত।

নানা মাধ্যমে ফুজির নাগাল পাওয়ার চেষ্টায় দেখা গেছে আশি হ্রদের বিভিন্ন রূপ। আগ্নেয়গিরি থেকে সৃষ্ট হ্রদটার তীরেই রয়েছে প্রাচীন শিন্তো ধর্মের কয়েক শ বছরের পুরোনো মন্দির। আশি হ্রদের পাড়ে বসে যেমন উপভোগ করেছি শান্ত নীল জলধারা, তেমনি কেব্​ল কারে চড়ে কোমাগাতাকে পর্বতের চূড়ায় উঠে দেখেছি সূর্যাস্তের সময় কেমন বদলে যায় রোদ ঝলমলে লেকটা।

আশি হ্রদের মতো গোরা পার্কও রোদ ঝলমলে। ১৯১৪ সালে নির্মিত পাহাড়ঘেরা এই পার্কে ঢুকতেই স্বাগত জানায় খোলা আকাশ আর স্বচ্ছ পানির ফোয়ারা। সবুজের সমারোহ, ফুলের বাগান ছাড়াও পার্কটিতে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী জাপানি টি–হাউস। বহু বছর আগে জঙ্গলের ভেতরের এই টি–হাউসে ঐতিহ্যবাহী চা উৎসব করত জাপানিরা।

পাহাড়ের কোলে হাকোন শহর
পাহাড়ের কোলে হাকোন শহর

উৎসব আরও আছে

একদিন গেলাম কামাকুরা নামের একটা শহরে। সাগরপারের এই শহরে বিশাল বুদ্ধমূর্তি। সেখান থেকে খুব কাছেই এনোশিমার বাতিঘর। সন্ধ্যায় চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা আর সুরে বর্ণিল হয়ে ওঠে সি ক্যান্ডেল নামের ৬০ মিটার উঁচু বাতিঘর এবং পার্ক। সার্ফিংয়ের জন্যও বেশ পরিচিত এনোশিমা। সকাল হলেই শত শত সার্ফার সার্ফবোর্ড নিয়ে হেঁটে বা সাইকেলে চেপে ছোটে সৈকতের দিকে। আর শিশুরা মা–বাবার হাত ধরে ভিড় করে এনোশিমা অ্যাকুরিয়ামে। বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী আর ডলফিনের খেলা দেখে আনন্দে মাতে ছেলেমেয়েরা।

কোমাগাতাকে পর্বতের চূড়ায় উঠে উপভোগ করা যায়  সূর্যাস্ত। ছবি: লেখক
কোমাগাতাকে পর্বতের চূড়ায় উঠে উপভোগ করা যায় সূর্যাস্ত। ছবি: লেখক

জাপানিরা যেখানে এক সুতোয় গাঁথা

জাপানের যোগাযোগব্যবস্থা অতুলনীয়। আট দিনে ঘুরেছি ছয়টি শহরের বিভিন্ন জায়গায়। জাদুঘরগুলোর কথা তো বলাই হলো না। এককথায় রূপ-বৈচিত্র্যে জাপানের একেকটা জায়গা একেক রকম। কিন্তু বিনয়, সহমর্মিতা, শৃঙ্খলা, ভদ্রতায় সব জাপানি যেন এক সুতোয় গাঁথা। এই শান্ত মানুষগুলোই জাপানের আসল সৌন্দর্য। আরিগাতো গোজাইমাস জাপান!

তথ্য সত্য

● জাপানে ‘বিড়াল ক্যাফে’ রয়েছে, যেখানে গিয়ে আপনি কফি পান করতে পারেন, পারেন বিড়ালের সঙ্গে সময় কাটাতে। জাপান ছাড়া এমন ক্যাফের দেখা মেলে কোরিয়ায়।

● ২০১৫ সাল পর্যন্ত জাপানে মধ্যরাতে নাচানাচির ব্যাপারে বাধ্যবাধকতা ছিল।

● জাপানে প্রতিবছর প্রায় ১ হাজার ৫০০ বার ভূমিকম্প হয়।

● জাপানের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৫০ হাজার মানুষের বয়স ১০০ বছরের ওপরে।

● ‘কঙ্গো গুমি অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে বিশ্বের সবচেয়ে পুরোনো প্রতিষ্ঠানটি ছিল জাপানে। ২০০৬ সালে বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানটির গোড়াপত্তন হয়েছিল ৫৭৮ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে।

● জাপানে প্রায় ৬ হাজার ৮০০ দ্বীপ রয়েছে।

● বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মধ্যে জাপানের ট্রেন–ব্যবস্থা সবচেয়ে সময়নিষ্ঠ। এ দেশের ট্রেনগুলো গড়ে বিলম্ব করে ১৮ সেকেন্ড।

● জাপানে শিশুদের ডায়াপারের চেয়ে বুড়োদের ডায়াপারের বিক্রির পরিমাণ বেশি!

● জাপানে একটি ভবনের পাট ফুঁড়ে মহাসড়ক চলে গেছে। ভবনটি ‘গেট টাওয়ার বিল্ডিং’ নামে পরিচিত।

● অকুনোশিমা জাপানের ছোট্ট দ্বীপ। তবে এই দ্বীপটি ‘র​্যাবিট আইল্যান্ড’ নামেই পরিচিত! হাজার হাজার মুক্ত খরগোশ এখানে ঘুরে বেড়ায়।

● জাপানে অধিকাংশ সড়কের নাম নেই।

● শুধু জাপানের মানুষই পারে ২০ ভাবে ‘দুঃখিত’ বলতে।

সূত্র: হাফিংটন পোস্ট, বিবিসি, ফ্যাক্ট স্লাইড