বলগুলো এমন করে মেয়েটির হাতে এসে পড়ছে, দেখে মনে হচ্ছে তাঁর ডাকেই পাখির মতো ওরা হাতে এসে বসছে। আবার মেয়েটির দাঁতে ধরা কাঠির ওপরে একটি কাচের গ্লাস উড়ে এসেই বসছে। তাঁর এই প্রদর্শনী প্রথম দর্শনে জাদু বলে ভুল হতেই পারে। আবার কেউ মনে করতে পারেন কোরিয়া বা চীনের শিল্পীদের প্রদর্শনী দেখছেন। আসলে তা নয়, তিনি আমাদের দেশের মেয়ে। নাম আকলিমা হাওলাদার। বাড়ি রাজবাড়ী জেলায়। এই খেলাকে বাংলায় বলা হয় মল্লক্রীড়া বা দড়াবাজি। আর বেশি পরিচিত ইংরেজি অ্যাক্রোবেটিক শব্দেই।
আমাদের আকলিমা এই কসরত চীন ও কোরিয়ার শিল্পীদের কাছ থেকেই শিখেছেন। আকলিমাদের দলের সদস্য ২৫ জন। বেশির ভাগের বাড়ি রাজবাড়ীতে। সেখানে রয়েছে দেশের একমাত্র অ্যাক্রোবেটিক সেন্টার। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর পরিকল্পনায় প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁরা সারা দেশে প্রদর্শনী করছেন। গত নভেম্বরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাঁদের প্রদর্শনী হয়।
বড় কোনো প্যান্ডেল নয়; বরং ছোট্ট একটি মঞ্চ। পেছনে একটি পর্দা। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা হচ্ছে সার্কাস ও যাত্রার ঢঙে। ঘোষণা শুনেই দর্শক সারি থেকে সবাই হাঁ করে থাকছেন, এই বুঝি অবাক করা কিছু একটা কী আসছে। ঠিকই অবাক হওয়ার মতোই সব ঘটনা ঘটছে ছোট্ট মঞ্চে খোলা আকাশের নিচে। খেলাগুলোর একটির নাম ‘জলি সিমেন্ট’। শুধু একটি পাইপের সঙ্গে কত রকম খেলা করা যায়, সে এক অবিশ্বাস্য ব্যাপার। ‘হ্যান্ড স্কিল’ পর্বে আছে প্রায় ১০ রকম খেলা। তিনজনের হাতের ভেতর দিয়ে নয়টি কাঠি কখন কার হাতে গিয়ে ধরা দিচ্ছে, সে আরেক চমক। রাজশাহীর শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুবেরি মাঠে আয়োজিত এই প্রদর্শনীর অধিকাংশ দর্শক ছিল শিশু। এই প্রদর্শনীর কোনো দর্শনী নেই।
‘চেয়ার সেটিং কমিক’ দর্শকদের খুবই আনন্দ দিয়েছে। বর্ণিল পোশাক পরা দুই শিল্পী গোলাম মওলা ও আনোয়ার হোসেন কীভাবে একটি ছোট্ট চেয়ারের দখল নিতে গিয়ে একজন আরেকজনকে নাজেহাল করছেন, তা দেখে হাসতে হাসতে পেটে খিল! একপর্যায়ে দেখা যায়, ফাঁকিবাজি করে দুজনে একটি চেয়ারের দখল নিতে গিয়ে শুধু নাজেহালই হচ্ছেন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা হাতে হাত মিলিয়ে দুজনেই এক চেয়ারে বসেন। খেলাটি একই সঙ্গে মজার ও শিক্ষণীয়।
শ্বাসরুদ্ধকর আরেক খেলার নাম ‘ব্যারেল ব্যালান্স’। মিজানুর রহমানের সঙ্গে খেলাটিতে অংশ নেয় ছোট্ট শিশু আহাদ। মিজানুর রহমান মাটিতে শুয়ে পা দুটি আকাশের দিকে উঁচু করলেন। তাঁর পায়ের ওপরে একটি ব্যারেল দেওয়া হলো। ব্যারেলটি তাঁর পায়ের ওপর ঘুরছে। তিনি পা সরিয়ে সরিয়ে ব্যারেলটাকে পড়তে দিচ্ছেন না। বারে বারে মনে হচ্ছে এই বুঝি ব্যারেলটা পা থেকে পড়ে যাবে। এ অবস্থায় ব্যারেলের ওপরে তুলে দেওয়া হলো শিশু আহাদকে। এই ব্যারেলের ওপরেই পা সরিয়ে সরিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শিশু আহাদ। ব্যারেল ঘুরছে আহাদও জায়গা বদল করছে। ব্যারেলের ওপরে দাঁড়িয়ে শিশুটি দর্শকদের উদ্দেশে একটি উড়ন্ত চুমুও ছুড়ে দিল। আর করতালিতে মুখর হয়ে উঠল জুবেরি মাঠ।
শিল্পী কালিম হোসেন যখন ‘রোলার ব্যালান্স’ নিয়ে হাজির হলেন, তখন আগের সব খেলাকে যেন ছাড়িয়ে গেলেন। একটি চাকার ওপরে কাঠের ছোট্ট একটি খণ্ড রেখে তার ওপরে উঠে নিজের ভারসাম্য রাখা। এবার ওই কাঠের ওপরে রঙিন পানি ভরা চারটি গ্লাস রেখে, তার ওপর আরেকটি কাঠ রেখে নিজের ভারসাম্য রাখা চাট্টিখানি কথা নয়। এগুলোর ওপর আরও একটি কাঠ রেখে তাতে যখন তিনি উঠতে যাচ্ছিলেন, তখনই দর্শক সারিতে শোরগোল পড়ে যায়। একইভাবে রিনা আক্তারের শরীর ঘিরে যখন ছয়টি রিং ঘুরতে লাগল, তখন সবাই যেন রোলার ব্যালান্সের কথা ভুলে গেল।
আয়োজকেরা জানান, অ্যাক্রোবেটিক সেন্টারের এই শিল্পীরা দেশের সব বিভাগেই একে একে তাঁদের প্রদর্শনী নিয়ে যাচ্ছেন। ১৯৯৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত তাঁদের ৪০০ প্রদর্শনী হয়েছে। ছোটদের একটি দল চীন থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে এসে প্রদর্শনী করছে। আরেকটি দল তিন বছরের প্রশিক্ষণের জন্য চীনে যাচ্ছে।
প্রদর্শনী শেষে কথা হয় শিল্পীদের সঙ্গে। হাজার হাজার দর্শককে আনন্দ দেওয়া এই শিল্পীরা তাঁদের একটি দাবির কথা জানালেন। তাঁদের সারা বছর অনুশীলন করতে হয়। শরীর ঠিক রাখতে হয়। এ জন্য তাঁদের ব্যয় হয়। কিন্তু প্রদর্শনী সব সময় হয় না। যখন প্রদর্শনী হয়, তখনই তাঁদের সম্মানী দেওয়া হয়। অন্য সময় তাঁদের বড় দুর্দিন যায়। যেহেতু এই খেলাকে তাঁরা পেশা হিসেবে নিয়েছেন। তাঁরা অন্য কাজে যেতে পারেন না। শিল্পকলা একাডেমির শিল্পী হিসেবে মাসিক বেতন-ভাতা চান। সেই সঙ্গে বলেন, দেশের একমাত্র অ্যাক্রোবেটিক সেন্টারের অবস্থাও খারাপ। সংস্কার করা দরকার।