>জাতিসংঘের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীবিষয়ক স্থায়ী ফোরাম-ইউএনপিএফআইআই যে আনুষ্ঠানিক লোগোটি ব্যবহার করে, তার নকশাকার বাংলাদেশের রিবেং দেওয়ান। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া এই চাকমা তরুণ চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ার সময় লোগোটি নকশা করেছিলেন। শুনিয়েছেন সেই গল্প।
স্কুলে এলেন শুভদর্শী ভিক্ষু
২০০৫ সাল। রিবেং চতুর্থ শ্রেণির ছাত্র। রাঙামাটি সদরের ভেদভেদি গ্রামে রিবেংদের বাড়ি। সেখান থেকেই পাশের মনোঘর প্রি-ক্যাডেট স্কুলে যান। সেদিন ক্লাস করছিলেন। একটি ঘোষণা জানাতে এলেন ভান্তে শুভদর্শী ভিক্ষু। ক্লাসে ক্লাসে গিয়ে তিনি জানাচ্ছিলেন, জাতিসংঘের একটি সংস্থা লোগো প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছেন। লোগো কী জিনিস রিবেংয়ের ছোট মাথায় কিছুই ধরেনি। তবে শুভদর্শী যে কথাগুলো বলেছিলেন, তাতে তিনি বুঝেছিলেন—তাঁদের স্কুলের যেমন একটি পরিচিতি তুলে ধরা হয় ছবিতে, ঠিক তেমন কিছু আঁকতে হবে। বিরেং বলছিলেন, ‘অনেকের মতো আমারও তখন রং-পেনসিলের সঙ্গে সখ্য ছিল। বাড়ি ফিরে বাবাকে বললাম। তিনিও আমাকে সহায়তা করলেন।’
কিন্তু কী আঁকবেন, কীভাবে আঁকবেন কিছুই বুঝতে পারছিলেন না রিবেং। ‘তবে এটুকু মাথায় আসছিল—বন্ধুত্ব, সম্প্রীতি, শান্তি। বুঝতে শেখার পরই কিছু বিষয় মাথায় গেঁথে গিয়েছিল। শান্তিচুক্তি নিয়ে বাসায় কথা হতো। সম্প্রীতির বার্তা নিয়ে গাওয়া শিল্পী লাকী আখান্দ্ ও রণজিৎ দেওয়ানের কণ্ঠে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘‘চেঙে মেয়নি হাজলং’’ গানটি শুনতাম। মনের ভেতর ছুঁয়ে যেত।’
সম্প্রীতির সুর সব সময় মনের ভেতর বাজত। তার সঙ্গে বনপ্রহরী বাবার সহায়তায় তিনি আঁকলেন। কিন্তু যত সহজে আঁকলেন বলা হলো, ততটা সহজ ছিল না। প্রায় এক মাস চেষ্টার পর চূড়ান্ত হয়েছিল রিবেংয়ের আঁকা। তারপর অনেকের মতো তিনিও জমা দিয়েছিলেন।
হঠাৎ এল আমন্ত্রণ
একসময় ভুলতেই বসেছিলেন আঁকার কথা। ২০০৭ সাল। রিবেং তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে উঠেছেন। স্কুল বদলেছেন। একদিন স্কুল থেকেই ফিরছিলেন। বাড়ির কাছে আসতেই পাশের দোকান থেকে ডাক পড়ল রিবেংয়ের। ঘটনা কী। এগিয়ে গেলেন। দোকানদার তাঁর হাতে একটি খাম ধরিয়ে দিলেন। ইংরেজিতে ঠিকানা লেখা। বাসায় এলেন। বলছিলেন রিবেং, ‘সেদিন খাম আর খোলা হলো না। কারণ, বাসায় এসে দেখি বাবা অসুস্থ।’
কিছুদিন পর খাম খুলে তো চক্ষু চড়কগাছ। জাতিসংঘ থেকে পাঠানো আমন্ত্রণপত্র। সেই সঙ্গে জানানো হয়েছে, তার আঁকাটিই জাতিসংঘের আদিবাসী-বিষয়ক স্থায়ী ফোরাম লোগো হিসেবে নির্বাচিত করেছে।
রিবেং গেলেন নিউইয়র্কে
পরিবারের পক্ষ থেকে রিবেংয়ের কথা জানানো হলো চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়কে। চাকমা রাজা নিজেও আমন্ত্রিত ছিলেন সেই অধিবেশনে। তাঁর সহায়তায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হলো। রিবেং গেলেন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীবিষয়ক স্থায়ী ফোরামের বার্ষিক অধিবেশনে অংশ নিলেন। তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হলো সনদ। বিশ্বনেতাদের সামনে নিজের অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। রিবেং বলছিলেন, ‘১৫ দিনের সফর ছিল সেটা। পার্বত্য চট্টগ্রামের এক পাহাড়ি এলাকা থেকে যুক্তরাষ্ট্র, স্বপ্নের মতো ব্যাপার ছিল।’
সেই সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং অংশ নিয়েছিলেন। সে সময়ের স্মৃতিচারণা করে তিনি বলছিলেন, ‘এই লোগো প্রতিযোগিতা পৃথিবীজুড়ে জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলোতে হয়। অনেকে অংশ নিয়েছিল তখন। রিবেংয়ের লোগোটি সেরা হিসেবে নির্বাচিত হয়। নিউইয়র্কের সে সম্মেলনে আমিও ছিলাম। সারা বিশ্বের অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বাংলাদেশের নাম ঘোষিত হয়েছে এটা বড় সম্মানের, মর্যাদার ব্যাপার।’
সম্প্রীতি আর শান্তি
বৃক্ষপাতায়বেষ্টিত বিশ্বমানচিত্র। মানচিত্রে দেখা যাচ্ছে, করমর্দনরত দুটি হাত। পেছনে পাহাড়, সূর্য। সাদাচোখে এটুকুই আমরা দেখতে পাই। তখন রিবেং ব্যাখ্যা করতে থাকেন অন্তর্নিহিত অর্থ, ‘এখানে বিশ্বমানচিত্র জলপাইপাতাবেষ্টিত। জলপাইপাতা শান্তির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। মানচিত্রে করমর্দনরত দুটি হাত, হাত দুটি ভিন্ন ধর্মের, ভিন্ন জাতিসত্তার মানুষের বন্ধুত্ব বোঝায়। পেছনে দুটি পাহাড়, দুটি ভূখণ্ড প্রকাশ করছে; ভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ যেখানে বন্ধুত্বের সঙ্গে, স্বকীয়তার সঙ্গে, সম্প্রীতি বজায় রেখে পাশাপাশি থাকবে।’ রিবেং দেওয়ান এখনো সেই সম্প্রীতির স্বপ্নই দেখেন। তাঁর লোগোর মতো মানুষের জীবনেও নেমে আসুক শান্তি আর সম্প্রীতির সবুজ ছায়া।