২৪ ঘণ্টায় 'ক্লিন' ঢাকা!
খাটের প্রতিটি পায়ার নিচে চারটি করে ইট দেওয়া। ফুটখানেক উঁচু হয়ে যাওয়া খাটের নিচে একটা বিছানা পাতা। সেই বিছানায় ঘুমায় দুই ভাই। হৃদয় আর আজাদ। খাটের ওপর বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘুমায় আরেক ভাই আদর। অবশ্য মাঝেমধ্যেই ভোররাতের দিকে হৃদয় আর আজাদ খাটের ওপর গিয়ে শোয়। কারণ, তাদের বাবা মধ্যরাতেই কাজের জন্য বেরিয়ে যান। যখন শহরের কারও ঘুম ভাঙে না, তখন থেকেই কাজে নেমে যান জাহাঙ্গীর। পেশা যখন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর, তখন এই রুটিনে অভ্যস্ত হওয়া ছাড়া উপায় কী! তবে ঈদুল আজহা এলে...! না, ঈদ এলে ছুটি মেলে না তাঁর, বরং দায়িত্ব বাড়ে। যখন ঘোষণা দেওয়া হয় ২৪ ঘণ্টায় এই শহরের পশু কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করা হবে, তখন মূল দায়িত্ব কাঁধে এসে পড়ে জাহাঙ্গীরদের মতো পরিচ্ছন্নতাকর্মীদের ওপর।
৩০ আগস্ট সকালে রাজধানীর আগা সাদেক রোডে মুসলিম কলোনির যুব সংঘের অফিসে বসে কথা হয় জাহাঙ্গীরের সঙ্গে। নিয়মিত কাজ শেষ করে সবে ফিরেছেন তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা। দুটি ভবনে ২০০ পরিবারের মধ্যে জাহাঙ্গীর পরিবারের একটি। পরিবারের গল্প নয়, আমরা শুনতে চাই ঈদের মধ্যে ২৪ ঘণ্টায় এই শহরের যাবতীয় বর্জ্য কী করে নিশ্চিহ্ন হলো? ততক্ষণে তাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছেন অনেকেই। জাহাঙ্গীর জবাব দেওয়ার আগেই কথা শুরু করেন মিরণজল্লা মুসলিম কলোনি যুব সংঘের সহসভাপতি পরিচ্ছন্নতাকর্মী মো. মুমিন। তিনি বলেন, ‘ঈদের তিন দিন আগে মেয়র সাহেব (সাঈদ খোকন, মেয়র, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন) আমাদের ডেকে ঘোষণা দিয়েছেন, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যাবতীয় বর্জ্য অপসারণ করতে হবে। আমরা তাঁর কথামতো জানপ্রাণ দিয়ে চেষ্টা করেছি।’
সেই চেষ্টার নমুনা যেমন
ঈদের দিন অর্থাৎ ২২ আগস্ট ভোরে কাজে যাওয়া হয়নি কারও। আগে থেকেই পরিকল্পনা ছিল, ঈদের নামাজ পড়েই কলোনির সবাই নিজ নিজ সীমানায় চলে যাবেন। হয়েছেও তাই। পাশের মসজিদে গিয়ে ঈদের নামাজ শেষ করে বাড়ি ফিরে অল্প কিছু খেয়েই ছুটেছেন আগে থেকে নির্দিষ্ট করা সীমানায়। তারপর যে যেখানে বর্জ্য ফেলেছেন, সেখান থেকেই কুড়িয়ে গাড়ি অবধি পৌঁছে দিয়েছেন তাঁরা।
জাহাঙ্গীর বললেন, ‘বেশির ভাগ ঢাকাবাসী সিটি করপোরেশনের নির্ধারিত স্থানে কোরবানি করেনি। সবাই যার যার বাসার সামনে বা রাস্তায় কোরবানি করেছে। যেহেতু এলাকাটা পুরান ঢাকা। তাই অলিগলি বেশি। আমরা সেই অলিগলিতে গিয়ে টুকরিতে করে সব বর্জ্য তুলে এনেছি। সেখান থেকে হাতে চালানো ছোট ভ্যানে। তারপর গাড়িতে।’
মমিনের পাশে বসা ছিলেন আরেক পরিচ্ছন্নতাকর্মী। বললেন, ‘আমরা সেদিন রাত ১২টা অবধি কাজ করেছি। তিন–চার ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে পরদিন ভোর থেকে আবার। আমাদের লক্ষ্যই ছিল মেয়রের কথামতো ২৪ ঘণ্টায় শহর পরিষ্কার করে ফেলা।’
সঙ্গে মুমিন যোগ করলেন, ‘এটা করার জন্য সবার সহযোগিতা ছিল। আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ কর্মকর্তারা সহযোগিতা করেছেন। সঙ্গে এলাকাবাসীও সহযোগিতা করেছেন। এ কারণেই সম্ভব হয়েছে।’
রাজধানীর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডে কাজ করেছেন তাঁরা। এভাবে প্রতিটি ওয়ার্ডেই সেদিন কাজ করেছেন কর্মীরা। সমন্বয়ের জন্য ছিলেন সিআই কর্মকর্তা, ওয়ার্ড কমিশনার। আর বাড়তি কাজের জন্য ছিল অতিরিক্ত কর্মী।
অতিরিক্ত কাজ অতিরিক্ত কর্মী
সঠিক পরিকল্পনা এবং সবার সদিচ্ছার কারণেই এই অসাধ্য সাধন হয়েছে। এমনটাই জানালেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা এয়ার কমোডর মো. জাহিদ হোসেন। তিনি বললেন, ‘মেয়রের ঘোষণার পরপরই আমরা একটা পরিকল্পনা করি। আসলে ২০১৬ সাল থেকে আমরা চেষ্টা করছি ২৪ ঘণ্টায় বর্জ্য পরিষ্কারের। প্রথম বছর পারিনি। পরের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালে অনেকটা সফল। এবার ৯০ ভাগ সফল হয়েছে।’
বাকি ১০ শতাংশ? শুধু বাসাবাড়ির বা কোরবানির বর্জ্য পরিষ্কার করতে হয়েছে এমন নয়। রাজধানীর পশুর হাটের বর্জ্যও রয়েছে। ১০ ভাগ না হওয়ার কারণ হলো, এবারের হাটের বেশ কিছু গরু অবিক্রীত ছিল। সেগুলোকে ফেরত নিয়ে যাওয়ার জন্য ঈদের দিন বা পরের দিন যাওয়ার মতো বাহন পাওয়া যাচ্ছিল না। এ ছাড়া ঢাকায় এক দিনে কোরবানি হয় না, অনেক জায়গায় তিন দিনই পশু কোরবানি দেওয়া হয়। এ কারণে শতভাগ বলা যায় না।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিয়মিত পরিচ্ছন্নতাকর্মী ৫ হাজার ২০০। এ ছাড়া ঈদের জন্য অতিরিক্ত আরও তিন হাজার কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। কাজের পদ্ধতি প্রসঙ্গে মো. জাহিদ হোসেন বললেন, ‘আগে থেকেই এলাকার প্রতিটি বাড়িতে ময়লা রাখার জন্য বস্তা পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল। তারপর কয়েকটা ধাপে মনিটরিং করা হয়। প্রথমত কাউন্সিলর, সিআই (কনজারভেশন ইন্সপেক্টর), এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ৫-৮ জনের কমিটি করা হয়। তারপর তাঁদের মনিটরিংয়ের জন্য সিটি করপোরেশন থেকে বিশেষ সেল গঠন করা হয়। সর্বশেষ ছিল পাঁচ সদস্যের বিশেষ কমিটি। যাঁরা ঈদের পরে দুদিন সারা শহর ঘুরে বেড়িয়েছেন। এই কমিটিতে মো. জাহিদ হোসেন ছাড়াও ছিলেন সচিব মো. শাহাবুদ্দিন খান, মহাব্যবস্থাপক (পরিবহন) নিতাই চন্দ্র সেন, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক সার্কেল) মো. আনিছুর রহমান এবং মেয়রের একান্ত সচিব মো. মোস্তফা কামাল মজুমদার।
সহযোগিতা করেছে প্রযুক্তি
বর্জ্য পরিষ্কারে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে প্রযুক্তি। বিশেষ করে ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ, ভাইবারের মতো অ্যাপগুলো কাজে লেগেছে। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পুরো এলাকা তিনটা অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছিল। প্রতিটি অঞ্চল থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে ফেসবুক ক্লোজ গ্রুপের মাধ্যমে লাইভ দেখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সারাক্ষণ সেটার আপডেট নেওয়া হয়েছিল। ময়লা দেখা গেলেই দ্রুত তা পরিষ্কার করার কথা বলা হচ্ছিল লাইভে। একই সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করা হয়েছিল, যেখানে চলছিল পরিষ্কার ঢাকার ছবি আদান–প্রদান। এ ছাড়া ছিল মুঠোফোন নম্বর। যেখানে ময়লা নিয়ে বিপদে পড়া বাসিন্দারা ফোন করলে মুহূর্তেই সমাধান পেয়েছেন।
ঢাকা উত্তরেও একই চিত্র
পরিকল্পনা ছিল একটাই। ২৪ ঘণ্টায় ময়লা পরিষ্কার করতে হবে। এমন চিন্তা নিয়ে প্রস্তুত ছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। প্রস্তুতি অনুযায়ী কাজ শুরু হয়েছিল ঈদের দিন দুপুর থেকেই। সেটা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। জানালেন অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আবুল হাসনাত মো. আশরাফুল আলম। ২৮টি ওয়ার্ডের জন্য ছিলেন চার হাজার পরিচ্ছন্নতাকর্মী। এ ছাড়া আরও ৫ হাজার খণ্ডকালীন কর্মী নেওয়া হয়েছিল। সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছিল প্রযুক্তি। আশরাফুল আলম বললেন, ‘আমরা কাউন্সিলর ও বিভিন্ন সোসাইটির মাধ্যমে আগে বস্তা বিতরণ করেছিলাম। এ ছাড়া ভ্যান সার্ভিসের মাধ্যমে ময়লা সংগ্রহকারীদের দিয়েও সংগ্রহ করেছি। আর বাড়তি ময়লা সংগ্রহের জন্য বাড়তি কনটেইনার নেওয়া হয়েছিল। এ কারণেই দ্রুত সময়ে ময়লা সংগ্রহ করা সম্ভব হয়েছিল।’