একজন বাঙালির কাছে একবার হেরে গিয়েছিলেন বিল গেটস। বিল গেটসের বইকে পেছনে ফেলে চট্টগ্রামের ছেলে সুবীর চৌধুরীর বই হয়েছিল ইউরোপের এক নম্বর বাণিজ্যবিষয়ক বই।
সুবীর চৌধুরীর বইটা ছিল ম্যানেজমেন্ট ২১ সি। ২০০০ সালে এ বই বের করেছিল ফিন্যান্সিয়াল টাইমস, যুক্তরাজ্য। আর বিল গেটসের বইটা ছিল বিজনেস অ্যাট দ্য স্পিড অব থটস। সুবীর চৌধুরীর বই বিল গেটসের টাকে হারিয়ে ইউরোপের সেরা বাণিজ্য-গ্রন্থের সম্মান অর্জন করেছিল।
নিউইয়র্ক টাইমস সুবীর চৌধুরীকে অভিধা দিয়েছে ‘লিডিং কোয়ালিটি এক্সপার্ট’ বা ‘নেতৃস্থানীয় উৎকর্ষ বিশেষজ্ঞ’। তিনি বিশ্বের ১ নম্বর বেস্টসেলিং লেখক, যাঁর লেখার বিষয় ‘সিক্স সিগমা দর্শন’। বিজনেস উইক তাঁকে আখ্যা দিয়েছে ‘দ্য কোয়ালিটি প্রফেট’ বা ‘উৎকর্ষের ভবিষ্যদ্বক্তা’ বলে।
সুবীর চৌধুরীর নতুন বই দ্য ডিফারেন্স ইউএসএ টুডের সর্বাধিক বিক্রীত বইয়ের তালিকায় স্থান পেয়েছে। ‘দ্য থিংকারস ৫০’ তাঁকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদের তালিকায় স্থান দিয়েছে চারবার—২০১১ সালে ৫০, ২০১৩ সালে ৪০, ২০১৫ সালে ৩৯ আর ২০১৭ সালে থিংকারের তালিকায় তাঁর স্থান ২৭।
সুবীর চৌধুরী কোয়ালিটি বা গুণগত উৎকর্ষ বাড়াতে পরামর্শ দেন বড় বড় কোম্পানিকে। এসব কোম্পানির হাজার হাজার কোটি টাকা তিনি বাঁচিয়ে দিতে সাহায্য করেন, তেমনি হাজার হাজার কোটি টাকা লাভ করতেও তাদের তিনি সহযোগিতা করেন। তিনি পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যানেজমেন্ট কনসালট্যান্ট বা ব্যবস্থাপনা পরামর্শকদের একজন। ফরচুন ১০০ তাঁর গ্রাহক, যাদের বিলিয়ন ডলার বাঁচাতে তার কনসালট্যান্সি কাজে লেগেছে। তিনি এএসআই কনসালটিং গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)।
জেনারেল মোটর, হুন্দাই, কিয়া মোটরস, জেরক্স, ক্যাটারপিলার, আমেরিকান অ্যাক্সেল, বোস, দায়িয়ু, ফোর্ড—এ রকম বড় বড় কোম্পানি তাঁর গ্রাহক।
ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে এক মিলিয়ন ডলার দিয়ে তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবীর চৌধুরী-মালিনী চৌধুরী বাংলাদেশ স্টাডিজ সেন্টার।
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর নামে ফেলোশিপ আছে, তাঁর নামে ফেলোশিপ আছে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসেও।
তিনি যে কেবল এসব দৈত্যকায় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও উৎকর্ষ আর ব্যবস্থাপনা বিষয়ে আলো দেখান, তা-ই নয়, তাঁর দর্শন আসলে আলোকিত করছে অগণিত ব্যক্তিমানুষকেও। তাঁর বই পড়ে, তাঁর সিক্স সিগমা দর্শনে উদ্বুদ্ধ হয়ে মানুষ তার নিজের জীবনকেও গড়ে তুলছে, মানবিক আর গুণগত মানসম্পন্ন করে তুলছে। তাঁর ১৫টা সাড়া জাগানো বই আর বক্তৃতা উদ্বুদ্ধ করে চলেছে অসংখ্য মানবহৃদয়কে।
ছোট ছোট বক্তৃতা আর লেখার মাধ্যমেও তিনি সুন্দর করার চেষ্টা করছেন ব্যক্তিমানুষের জীবনকে।
‘আপনার জীবনকে কে সবচেয়ে প্রভাবিত করেছে?’ সুবীর চৌধুরী একটা লেখায় এই বিষয়ে বিল গেটসের উদাহরণ টেনেছেন। বিল গেটস মনে করেন, তাঁর জীবনে আরও একজন নারীর ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, আর তিনি হলেন তাঁদের স্কুলের লাইব্রেরিয়ান। যিনি বিল গেটসকে শিখিয়েছিলেন বই ভালোবাসতে।
সুবীর চৌধুরীকেও জিজ্ঞেস করেছিলাম, টেলিফোনে নেওয়া সাক্ষাৎকারে, আপনার জীবনে সবচেয়ে প্রভাব সৃষ্টিকারী মানুষ কে?
তিনি বলেছিলেন, আমার মা-বাবা আর আমার দাদু (মাতামহ)।
তাঁর বাবা সুশীল কুমার চৌধুরী চট্টগ্রামের চকবাজারে একটা ওষুধের দোকান চালাতেন। দোকানের নাম ছিল ‘বেগম ফার্মাসি’। ডাক্তারদের সঙ্গে তাই তাঁর বাবার ছিল ভালো যোগাযোগ। বাবা চাইতেন, সুবীর বড় হয়ে হোন একজন ডাক্তার।
সুবীরের জন্ম ১৯৬৭ সালে। তাঁর বড় মামা দয়াল হরি বিশ্বাস ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন।
তাঁর মাতামহ চিত্তরঞ্জন বিশ্বাস ছিলেন বালক সুবীরের আদর্শ।
একদিন তাঁর দাদু তাঁকে এক টাকার একটা মুদ্রা আর একটা কলম দেন। বলেন, যেকোনো একটাকে বেছে নাও।
ক্লাস ফোর-ফাইভে পড়া সুবীর বেছে নেন টাকা।
দাদু বলেন, দাদুভাই, টাকা নয়, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো কলম। এই কলম দিয়েই পৃথিবীর সব জ্ঞান লিখে রাখা হয়েছে। কত গুণী মানুষ জ্ঞানী মানুষ পৃথিবীতে এসেছেন, তাঁদের সবার কথা আমরা জানি। কারণ, কলম সেসব লিখে রেখেছে। পৃথিবীটা এগোচ্ছে জ্ঞান দিয়ে, আর জ্ঞানের জন্য আছে কলম। সুবীর চৌধুরীর জগৎ পাল্টে গেল। তিনি বই পড়তে শুরু করলেন। আর চিঠি লিখতে শুরু করলেন সাহিত্যিকদের। তিনি চিঠি লিখতেন কবি শামসুর রাহমানকে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে, সত্যজিৎ রায়কে।
একবার দুবার তিনবার। শেষে তাঁদের কাছ থেকে জবাবও আসতে লাগল। উত্তমকুমারের ভাই তরুণকুমারের সঙ্গে তাঁর খাতির উঠল জমে।
আরেক দিনের ঘটনা। স্কুলে বার্ষিক পরীক্ষা। ফল বেরোল। সুবীর ফার্স্ট হয়েছেন। যিনি দ্বিতীয় হয়েছেন, তাঁর অভিভাবক বললেন, একটা হিন্দু ছেলে ফার্স্ট হয়ে গেল!
শুনে সুবীর মন খারাপ করেছিলেন।
দাদু বললেন, মন খারাপ কোরো না। তোমার হাতের পাঁচটা আঙুল কি সমান? সবাই এক রকম হয় না। যে তোমাকে আঘাত দেবে, যখন তোমার সুযোগ আসবে, তাকে তুমি আঘাত করবে না, বরং পারলে তারও উপকার করবে।
তিনি বললেন, যাঁরা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানুষ, শ্রেষ্ঠ মনীষা, তাঁরা কোনো একটা ধর্মের নন, কোনো একটা গোষ্ঠীর নন, কোনো একটা সময়ের নন, তাঁরা সবার, সমস্ত মানবজাতির, তাঁরা চিরকালের।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক দাদু তাঁকে এইভাবে বিশ্বমানব হওয়ার স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ করতেন।
চট্টগ্রাম সরকারি হাইস্কুলের ছাত্র ছিলেন সুবীর। তারপর চট্টগ্রাম কলেজ। এরপর বাবার ইচ্ছায় তিনি ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। ছয় মাস পড়েছিলেন সেখানে। তারপর ডাক আসে খড়গপুর আইআইটি (ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি) থেকে। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে। তখন তাঁর স্বপ্ন—তিনি নভোচারী হবেন, নাসায় কাজ করবেন। চলে গেলেন ভারতে।
সেখানে গিয়ে তিনি বুঝলেন, বড় মানুষদের সঙ্গে তাঁর পত্রযোগাযোগ কত কাজে লাগছে! তিনি যখন বললেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর কথা হয়, সমরেশ বসুকে তিনি চিঠি লেখেন, তরুণকুমার তাঁর পূর্বপরিচিত, তখন বন্ধুদের চোখ ছানাবড়া।
সুবীর চৌধুরী বললেন, আমরা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ি বটে, কিন্তু আমাদের সাহিত্যের সঙ্গে যোগাযোগ থাকতে হবে, আমরা এই প্রতিষ্ঠান থেকে বের করব সাহিত্য পত্রিকা। তিন বছর ক্রমাগত চেষ্টা করে তিনি আইআইটি থেকে তহবিল আর অনুমতি—দুটোই বের করতে সক্ষম হলেন। তাঁর কাগজে লেখা ছাপা হলো সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের। সাক্ষাৎকার দিলেন সত্যজিৎ রায়।
পরবর্তীকালে আইআইটি খড়গপুর সুবীর চৌধুরীকে বিশিষ্ট অ্যালামনাস পুরস্কারে ভূষিত করেছে।
আর তাঁর সেদিনের অভিজ্ঞতা তাঁকে নিয়ে এসেছে আজকের অবস্থানে। তিনি ১৫টি সর্বাধিক বিক্রীত (বেস্টসেলার) বইয়ের জনক। যে বইগুলো লেখা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা কিংবা মান বিষয়ে, কিন্তু সেসব তিনি লিখেছেন গল্পের মতো করে, মজার ভাষায়, কাল্পনিক চরিত্র আর সংলাপ দিয়ে দিয়ে।
তিনি বলেন, সেই যে আমি বড় মানুষদের চিঠি লিখতাম, সেটা আমাকে গড়ে তুলেছে একজন ভয়হীন যোগাযোগকারী হিসেবে (ফিয়ারলেস কমিউনিকেটর)। আমাকে এখন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে কথা বলতে দিলেও আমি একটুও ঘাবড়াই না।
তিনি স্মরণ করেন তাঁর বাবাকে। বাবা বেশি দূর লেখাপড়া করেননি। ছোটবেলায় তিনি বাবা-মাকে হারান। বাবা তাঁর মামার বাড়িতে মানুষ হয়েছিলেন। বাবা সুবীরকে শিখিয়েছিলেন শৃঙ্খলা। কঠোর নিয়মানুবর্তিতা। সুবীরকে ঘুম থেকে উঠতে হতো ভোর সাড়ে চারটায়, এরপর এক ঘণ্টা দৌড়, ফিরে এসে তবলা শেখো, তারপর যোগব্যায়াম, তারপর পড়তে বসো, তারপর স্নান করে খেয়ে নিয়ে যাও স্কুল।
বাবা নিজে লেখাপড়া শেষ করতে পারেননি, কিন্তু ক্লাস এইটে বিয়ে করে ঘরে আনা তাঁর স্ত্রী কৃষ্ণাকেশী চৌধুরী মানে সুবীরের মাকে বিএ পাস করিয়েছিলেন।
আইআইটি খড়গপুর থেকে ১৯৮৯ সালে সুবীর চৌধুরী চলে এলেন ঢাকায়। কাজ করলেন অ্যাপল কম্পিউটারে, সিপ্রোকো নামের প্রতিষ্ঠানে।
তাঁকে বললাম, ঠিক একই সময়ে আমিও অ্যাপল কম্পিউটারের প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে পরোক্ষভাবে যুক্ত ছিলাম, মোস্তাফা জব্বাররা সাইটেকে আমাদের ট্রেনিংও দিয়েছিলেন।
সুবীর চৌধুরী হাসলেন। তাঁরও মনে পড়ছে সেসব দিনের কথা।
ওই সময় তিনি ঢাকায় সিলিকন নামের তথ্যপ্রযুক্তি পত্রিকা শুরু করেছিলেন। সেটা বাংলাদেশের প্রথম এই বিষয়ের কোনো পত্রিকা।
এরপর সুবীর মাস্টার্স করতে চলে যান আমেরিকায়। ১৯৯১-১৯৯৩ সালে সেন্ট্রাল মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করেন।
১৯৯৩ সালে তিনি কোয়ালিটি প্রকৌশলী হিসেবে যোগ দেন জেনারেল মোটরসে। ‘ওই সময় আমি দেখলাম, তিনটা বড় গাড়ি কোম্পানি, কোয়ালিটির জন্য তিনটা স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করে। আমি বললাম, স্ট্যান্ডার্ড যদি অভিন্ন হয়, তাহলে তো সবার অর্থ, সময় সাশ্রয় হবে, লাভ বাড়বে। আমি পেপার প্রেজেন্টেশন করলাম। সেই প্রেজেন্টেশন শুনে প্রকাশক বললেন, এটাকে বই করতে হবে। আমি বললাম, তোমার মাথা খারাপ। আমি কখনো বই লিখেছি নাকি? তারা বলল, শুরু করো, হবে।’
১৯৯৬ সালে বের হলো কেন জিমারের সঙ্গে লেখা তাঁর বই কিউএস-৯০০০ পাইওনিয়ারস। তিনি প্রকাশককে বললেন, এই বইয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ সেরা ম্যানেজমেন্ট-গুরুদের প্রশংসাবাণী থাকতে হবে। তখনকার সেরা ম্যানেজমেন্ট-গুরুরা তাঁর বইয়ের প্রশংসা করে বাণী দিয়েছিলেন।
তাঁর সেই বই বিক্রি হতে লাগল।
এরপর একের পর এক বই বেরিয়েছে, আর সেসবের মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে।
দ্য পাওয়ার অব সিক্স সিগমা বইটি ২৫ ভাষায় অনূদিত হয়েছে, ক্যাটারপিলার ৭২ হাজার কপি কিনে তার কর্মীদের মধ্যে বিলি করেছে।
পাশাপাশি চলতে লাগল তাঁর কনসালট্যান্সি। দুনিয়ার বড় বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কোয়ালিটি বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে তাঁদের লোকসান বন্ধ করে লাভের মুখ দেখাতে লাগলেন তিনি।
ফরচুন ৫০০ কোম্পানিরা তাঁর গ্রাহক।
একবার এমনই একটা বিশাল প্রতিষ্ঠানের সিইও তাঁকে হায়ার করলেন তাঁদের প্রতিষ্ঠানের লোকসানের স্রোত বন্ধ করার জন্য।
সুবীর চৌধুরী বললেন, তোমার ছেলেমেয়ে কজন?
‘দেখো। তোমাকে আমি হায়ার করেছি আমার প্রতিষ্ঠানের লোকসান বন্ধ করার কনসালট্যান্সি করার জন্য। তোমার প্রতিটা মিনিটের জন্য আমাকে টাকা গুনতে হচ্ছে। তুমি কেন আমার সময় আর টাকা অপচয় করছ?’
‘তোমার প্রতিষ্ঠানের লাভ-লোকসানের সঙ্গে আমার প্রশ্নের সম্পর্ক আছে। বলো, তোমার ক ছেলেমেয়ে?’
‘আমার দুই মেয়ে।’
‘কবে তাদের সঙ্গে তুমি কথা বলেছ?’
‘দেখো, তোমার সঙ্গে আমি বিজনেস নিয়ে কথা বলতে এসেছি। সংসার নিয়ে নয়।’
‘আচ্ছা, এই এক ঘণ্টার জন্য তোমাকে পয়সা দিতে হবে না। বলো, কবে তুমি তোমার মেয়েদের সঙ্গে কথা বলেছ?’
‘আমার তা মনে নাই।’
‘যাও। তুমি তোমার মেয়েদের কাছে যাও। ওদের সঙ্গে সময় কাটাও। ওদের সঙ্গে গল্প করো। এইটাই তোমার কোম্পানির লোকসান বন্ধে আমার এক নম্বর ওষুধ।’
সিইও কথা শুনলেন। তিনি নিউইয়র্কে গেলেন মেয়ের সঙ্গে কথা বলতে। পরবর্তীকালে তাঁর কর্মীদের বললেন, পরিবারের সঙ্গে সময় দাও।
ওই প্রতিষ্ঠান পরে লোকসান কাটিয়ে লাভের মুখ দেখতে শুরু করে।
পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের জন্য।
সুবীর চৌধুরী তাঁর স্ত্রী মালিনী চৌধুরী আর ছেলেমেয়েকে নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে থাকেন। থাকেন ট্রাম্প এস্টেটসে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে রিয়েল এস্টেট ব্যবসার চুক্তি আছে তাঁর, ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার আগে থেকেই। ট্রাম্প এস্টেটে সুবীরের বাড়ি দেখতে এসেছিলেন ট্রাম্প, বাড়ির কোয়ালিটি দেখে তিনি মুগ্ধ। ট্রাম্পের ছেলে এরিখ সুবীর চৌধুরীর সঙ্গে দুটো বাড়ি করার চুক্তি করেন।
সুবীর চৌধুরীর দুই ছেলেমেয়ে। আনন্দী চৌধুরী আর অনিশ চৌধুরী। মালিনী চৌধুরী পড়াশোনা করেছেন কস্ট অ্যাকাউন্ট্যান্সি নিয়ে, এখন সুবীর চৌধুরী–মালিনী চৌধুরী ফাউন্ডেশনের পরিচালক হিসেবে কাজ করছেন। এই ফাউন্ডেশন আইআইটি খড়গপুরে ১ মিলিয়ন ডলার অনুদান দিয়েছে, আর ভারত সরকার দিয়েছে এক মিলিয়ন ডলার, প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সুবীর চৌধুরী স্কুল অব কোয়ালিটি অ্যান্ড রিলায়বিলিটি।
সুবীর চৌধুরী অনেক পুরস্কার আর স্বীকৃতি পেয়েছেন জীবনে। সোসাইটি অব ম্যানুফাকচারিং ইঞ্জিনিয়ার্স স্বর্ণপদক, সোসাইটি অব অটোমোটিভ ইঞ্জিনিয়ার্স হেনরি ফোর্ড স্বর্ণপদকসমেত অনেক পুরস্কার আর ফেলোশিপ। তাঁর বাবা-মাকে চট্টগ্রাম থেকে উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে তাঁদের সামনে পুরস্কার পরিয়ে দেওয়া হয়েছে ছেলের গলায়। মিশিগান টেকনোলজিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছে সম্মানসূচক পিএইচডি ডিগ্রি।
সুবীর চৌধুরীর বাবা মারা গেছেন বছর কয়েক আগে, মা বেঁচে আছেন, নিজের সময় তিনি ভাগ করে দেন বিভিন্ন দেশে সন্তান আর নাতি-নাতনিদের মধ্যে।
সুবীর চৌধুরীর অন্তরে আছে বাংলাদেশ।
তিনি তাই ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া বার্কলেতে প্রতিষ্ঠা করেছেন সুবীর চৌধুরী-মালিনী চৌধুরী সেন্টার ফর বাংলাদেশ স্টাডিজ। তাঁর দেওয়া এক মিলিয়ন ডলারের সঙ্গে বার্কলে ছয় লাখ ডলার যোগ করেছে।
কিছুদিন আগে আমার সুযোগ হয়েছিল সেই সেন্টারে যাওয়ার। আমি বাংলাদেশের সাহিত্য নিয়ে একটা বক্তৃতাও দেওয়ার সুযোগ পেয়েছিলাম সেখানে।
তারিশি জৈন, হোলি আর্টিজান বেকারিতে যাঁকে আমরা হারিয়েছি, বাংলাদেশে এসেছিলেন এই সেন্টারের বৃত্তি নিয়ে, বাংলাদেশ বিষয়ে গবেষণা করতে।
সুবীর চৌধুরী বলেন, দেশকে কি ভোলা যায়? দেশের অন্ন–জলে পুষ্ট হয়েছি, কলেজ পর্যন্ত দেশে লেখাপড়া করেছি, আজ যা করতে পেরেছি, তার মূলে তো দেশেরই শিক্ষা, দেশেরই প্রেরণা, দেশেরই খাদ্য।
তিনি বলেন, ‘আমার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে যাঁরা প্রেরণা দিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মুসলিম আছেন, হিন্দু আছেন, এখনো আমার বন্ধুদের তালিকায় আছে সব ধর্মের মানুষজন।’
‘ধর্ম নিয়ে হানাহানির খবর শুনলে আমি ব্যথা পাই।’
‘কিন্তু সবকিছুর ওপরে দেশ হলো দেশ।’
ব্যক্তিমানুষের জীবনে ‘কোয়ালিটি’ কীভাবে বাড়ানো যাবে?
সুবীর চৌধুরী: যেকোনো মানুষই তাঁর ব্যক্তিজীবনে গুণগত মান বাড়াতে পারেন।
একজন মানুষকে হতে হবে ১. স্ট্রেটফরোয়ার্ড (সরাসরি), ২. থটফুল (সুবিবেচক) ৩. অ্যাকাউন্টেবল (জবাবদিহিপূর্ণ), এবং তাকে করতে হবে ৪. রিসল্ভ (সমাধান)। আমার নতুন বই ডিফারেন্স-এ এটা ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
সুবীর চৌধুরী: বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের জন্য আমার বার্তা হলো—১. স্বপ্ন লালন করো ২. কঠোর পরিশ্রম করো ৩. কখনো হতাশ হবে না ৪. টাকার পেছনে ছুটো না, যা ভালো লাগে, তা করতে থাকো। তোমার কর্মক্ষেত্রে, তোমার বাড়িতে, তোমার সামাজিক জীবনে এগুলো অনুসরণ করতে থাকো। নিজেই হয়ে ওঠো পরিবর্তনের নায়ক।