এই নির্বাচনেও কেন সংখ্যালঘুরা মার খেলেন

নির্বাচন পরবর্তী সহিংসতার শিকার হয়েছেন বেশ কিছু সংখ্যালঘু পরিবারছবি : প্রথম আলো

বিএনপি ও সমমনা দলগুলো দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছে। তারা দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছে, যেন কেউ ভোট দিতে না যান। কিন্তু সংখ্যালঘু এলাকায় তাদের তৎপরতা কেবল আহ্বানের মধ্যে সীমিত ছিল না।

বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের দাবি, নির্বাচনের আগের রাতে লালমনিরহাট উপজেলার কুলাঘাট ইউনিয়নের যুবদলের নেতা-কর্মীরা লাঠিসোঁটা ও দেশীয় অস্ত্র নিয়ে স্থানীয় সংখ্যালঘু, বিশেষ করে জেলেদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এই বলে হুমকি দেন যে ‘ভোটকেন্দ্রে গেলে জাল ও নৌকা দুই-ই যাবে। ভোটকেন্দ্রে গেলে এলাকা ছাড়তে হবে। এটা আমাদের নেতার নির্দেশ।’ এই হুমকি ২০০১ সালের নির্বাচনের পরের ও আগের কথা মনে করিয়ে দেয়। তখন বিএনপির নেতা-কর্মীরা নির্বিচারে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা করেছেন, তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছেন।

লালমনিরহাটের এই যুবদল নেতার নাম-পরিচয় জানা দরকার। তিনি যখন এতই ক্ষমতাধর, তখন দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মী গ্রেপ্তার হওয়ার প্রতিবাদে ঢাকায় এসে একটা মিছিল করলেন না কেন?

দুর্বল সংখ্যালঘুরা ভোটকেন্দ্রে গেলে এক পক্ষের হাতে মার খান, না গেলে অন্য পক্ষের রোষানলে পড়েন।

ঐক্য পরিষদের দাবি অনুযায়ী, ৭ জানুয়ারি ঠাকুরগাঁও-১ আসনে তেনাই তোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ভোট দিয়ে ফেরার পথে বিএনপি-জামায়াতের কর্মীদের হামলায় রোশনি রায় ও জয়দেব বর্মণ নামের দুজন আহত হন। তাঁদের আঘাত গুরুতর বলে ঠাকুরগাঁও হাসপাতালে তাঁরা চিকিৎসাধীন।

এ তো গেল নির্বাচনবিরোধীদের অ্যাকশন। নির্বাচনপন্থীরা কী করেছেন, সেটাও একবার দেখা যাক। ৭ জানুয়ারি কুমিল্লার দাউদকান্দি পৌর সদরের বেগম আমেনা সুলতান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে ঈগল প্রতীকের সমর্থকেরা পিপলু সাহা ও রঞ্জন সাহা নামের দুজনকে কুপিয়ে আহত করেন। অভিযোগ, তাঁরা নৌকা প্রতীকের সমর্থক। এই ঘটনার পর কেন্দ্রটি ভোটারশূন্য হয়ে পড়ে।

টাকা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নির্বাচনের মাঠে আমার অবস্থান দুর্বল করার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমার প্রতিপক্ষ তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ভোটের মাঠে প্রচুর টাকা ছড়ানোর পাশাপাশি আমার ভোটব্যাংককে নিরুৎসাহ করতে আমাকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের মাঠ আমার পক্ষে থাকলেও সব মহলের আশীর্বাদ থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’

একই দিন ফরিদপুর-৩ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী এ কে আজাদের সমর্থক সংখ্যালঘুদের বাড়িঘরে হামলা চালান নৌকার সমর্থকেরা। এতে মাঝিপাড়ায় ১৫ জন আহত হন। চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলীতে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকদের হাতে আক্রান্ত হন সুরেশ চৌধুরী ও পঙ্কজ চন্দ। ৮ জানুয়ারি রাঙামাটি জেলার কাউখালীর দুর্গম এলাকায় তিন আওয়ামী লীগ সমর্থক অপহৃত হন। তারা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

একই দিন গাইবান্ধা-৫ আসনে নৌকার সমর্থকেরা কুলিপট্টি গ্রামে চার হিন্দু বাড়িতে হামলা চালান। তাঁরা শিবু রায়ের বাড়ি থেকে বিদেশি প্রজাতির ৫ লাখ টাকার ৮টি ছাগল নিয়ে যান। ভুক্তভোগী পরিবারগুলো স্বতন্ত্র প্রার্থী সাবেক ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বীর কন্যা ফারজানা রাব্বির সমর্থক ছিলেন। ৯ জানুয়ারি সাতক্ষীরা দেবহাট্টা ও সিরাজগঞ্জেও সংখ্যালঘুদের বাড়িতে লুটপাট ও হামলার ঘটনা ঘটেছে।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর ঢাকার কাছে কালীগঞ্জে একটি আক্রান্ত গ্রাম পরিদর্শন করতে গেলে সেখানকার এক প্রবীণ সংখ্যালঘু নারী হাতজোড় করে বলেছিলেন, ‘বাবা, ভোটের জন্যই তো এত মার খাওয়া। ঘরবাড়িতে আক্রমণ। তোমরা ভোটার তালিকা থেকে আমাদের নামটি বাদ দিয়ে দাও।’

২০০১ থেকে ২০২৪। বর্তমানে সংখ্যালঘুদের অবস্থা অতটা নাজুক না হলেও আজও ভোটের জন্য তাঁদের মার খেতে হয়।  আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলে তাঁরা বিএনপি-জামায়াতের হাতে মার খান। নৌকা প্রার্থীকে সমর্থন করলে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকেরা তাঁদের ওপর চড়াও হন। আবার স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করলে নৌকা প্রার্থীর সমর্থকেরা হামলা করেন। এ অবস্থায় তাঁরা কোথায় যাবেন?

আওয়ামী লীগ থেকে প্রায় অভিযোগ করা হয়, বিএনপি সাম্প্রদায়িক দল। যখনই তারা ক্ষমতায় আসে, তখন সংখ্যালঘুরা নির্যাতিত হয়। উদাহরণ হিসেবে ২০০১ সালের নির্বাচনের কথা বলা হয়। তাদের এই অভিযোগ অসত্য নয়। কিন্তু ১৭ বছর বিএনপি ক্ষমতার বাইরে এবং ১৫ বছর টানা অসাম্প্রদায়িক আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকার পরও সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন-হামলা থামছে না কেন? ২০২১ সালে দুর্গোৎসবের সময় কুমিল্লার একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা হলো?

গত আওয়ামী লীগ শাসনামলে(২০১৮-২০২৪) একজন দোর্দণ্ড প্রতাপশালী মন্ত্রী ও ফরিদপুর এলাকার সংসদ সদস্য বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্তর চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি  দিয়েছিলেন। সে সময়ে মন্ত্রিসভা কিংবা সংসদ সদস্যদের কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন, এমন প্রমাণ নেই।

এই প্রসঙ্গে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর একটি কথা মনে পড়ে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নকশালদের বিরুদ্ধে লাল ঘোড়া দাবড়িয়ে দেওয়ার কথা বলেছিল। এর জবাবে ভাসানী বলেছিলেন, নকশাল কারও গায়ে লেখা থাকে না। তেমনটি সাম্প্রদায়িকতাও দল বা ব্যক্তির গায়ে লেখা থাকে না। আচরণের মধ্য দিয়েই সেটি প্রমাণিত হয়।  

গত নির্বাচনে ধর্মীয় ও নৃতাত্ত্বিক সংখ্যালঘুরা ২২টি আসন পেয়েছিলেন। এবারে তাঁদের আসন কমে হয়েছে ১৪। এর পেছনেও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কি না, সেটা গবেষণার বিষয় হতে পারে।

এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা অসীম কুমার উকিলের প্রতিক্রিয়াটি তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করি। তিনি একাদশ সংসদের সদস্য এবং গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে নৌকা প্রতীক পেয়েও হেরেছেন। অসীম কুমার উকিল একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিয়ে বলেছেন, ‘দল এবং ভোটের মাঠ দুটোই আমার পক্ষে ছিল। কিন্তু দুটি কারণে আমাকে পরাজয় বরণ করতে হয়েছে।

টাকা এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নির্বাচনের মাঠে আমার অবস্থান দুর্বল করার যে ষড়যন্ত্র হয়েছিল, আমার প্রতিপক্ষ তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পেরেছে। ভোটের মাঠে প্রচুর টাকা ছড়ানোর পাশাপাশি আমার ভোটব্যাংককে নিরুৎসাহ করতে আমাকে জড়িয়ে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছিল। নির্বাচনের মাঠ আমার পক্ষে থাকলেও সব মহলের আশীর্বাদ থেকে আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে।’

দেশে দেশে নির্বাচন নিয়ে সংখ্যালঘুদের বঞ্চনার আরও অনেক নজির আছে। সরকারের কাজ হলো যেই সম্প্রদায় বা দলের লোক সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা-নির্যাতন করুক না কেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা।

এবারের নির্বাচনে প্রথম দুটি ঘটনা ছাড়া বাকি সব কটিই হয়েছে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রার্থী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে। এতে কার কতটা উসকানি বা প্ররোচনা ছিল, সেটাও খতিয়ে দেখা হোক।

হুকুমের আসামি কেবল বিরোধী দলে থাকবেন, ক্ষমতাসীন দলে নয় কেন?

  • সোহরাব হাসান কবি ও প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক