পাকিস্তানের সুপরিচিত সমাজসেবী ও কলাম লেখক আরদেশির কাওয়াসজি মারা যাওয়ার ১৩ বছর আগে এক সকালে টেলিফোনে শুনতে পেলেন পাকিস্তানের প্রয়াত সামরিক শাসক আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের পুত্র আলী ইয়াহিয়া খানের কণ্ঠস্বর।
‘আপনি তো মরণের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। আমার বাবাকে নিয়ে বই লিখবেন বলে যে কথা দিয়েছিলেন, কবে লিখবেন সেটা? আপনি যেসব কাগজপত্র চেয়েছিলেন, সবই তো আপনার কাছে পাঠানো হয়েছে। হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে তো আবার লেখালেখি হচ্ছে, বাবাকে নিয়ে বইটা লেখার এটাই উপযুক্ত সময়।’
‘ধৈর্য ধরুন। তাড়াহুড়া করে ইতিহাস লেখা যায় না। আরেকটা কথা, আমাদের বিখ্যাত ও কুখ্যাত জেনারেলদের পুত্রদের অনেকেই এখন প্রকাশ্যে বলা শুরু করেছেন, তাঁদের কঠোর পরিশ্রমী পিতারা তাঁদের জন্য কত কোটি কোটি টাকা রেখে গেছেন। আপনি কি প্রকাশ করতে প্রস্তুত, বাবার কাছ থেকে আপনি কত পেয়েছেন?’
টেলিফোনের তারের মধ্য দিয়ে রাওয়ালপিন্ডি থেকে ভেসে এল ছাপার অযোগ্য শব্দ।
ইয়াহিয়াকে নিয়ে কোনো বই কাওয়াসজি লেখেননি শেষ পর্যন্ত। ২০১২ সালে ৮৬ বছর বয়সে তিনি মারা গেছেন। ইয়াহিয়াপুত্র আলী তাঁকে যেসব কাগজপত্র পাঠিয়েছিলেন, তার মধ্যে ইয়াহিয়ার নিজের হাতে লেখা কিছু দিনপঞ্জির ফটোকপি ছিল। কাওয়াসজি করাচির ইংরেজি দৈনিক ডন-এ সেগুলোর কিছু কিছু অংশ তুলে ধরেছিলেন।
১৯৭৬ সালের ২৫ মে ইয়াহিয়া লিখেছেন: ‘হিটলারের প্রচারণামন্ত্রী ড. জোসেফ গোয়েবলস বলেছিলেন, এত বেশি পরিমাণে মিথ্যা কথা এত বেশিবার বলো, যেন লোকজন মিথ্যাগুলোকেই সত্য বলে বিশ্বাস করে। ড. গোয়েবলসের শিষ্যদের মধ্যে শোরার চেয়ে বেশি অনুগত কেউ ছিল না।’
শোরা ফারসি শব্দ। এর অর্থ, উটের মতো নিচের ঠোঁট ঝুলে পড়া মানুষ। ইয়াহিয়া ভুট্টোকে এই নাম দিয়েছিলেন। বলা হয়ে থাকে, ভুট্টোর প্ররোচণাতেই তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকে বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু করেন। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীসহ অনেকেই মনে করে পাকিস্তান ভাঙার মূল দায় ইয়াহিয়ার নয়, ভুট্টোর। পরে এ দুজনের মধ্যে ঘৃণার সম্পর্ক চরমে উঠেছিল, এ কথা এখন সুবিদিত। ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর ভুট্টোর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিলেন। ভুট্টো তাঁকে বন্দী করে রেখেছিলেন বান্নির জঙ্গলের এক বাংলোতে। বাইরের দুনিয়া থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে। তারপর তাঁকে নিজের বাড়িতে ফিরতে দিয়েছিলেন বটে, তবে সেখানেও ইয়াহিয়া ছিলেন গৃহবন্দী।
ইয়াহিয়ার সঙ্গে কাওয়াসজির শেষ দেখা হয়েছিল ১৯৭৬ সালের এক সকালে। রাওয়ালপিন্ডির হারলে স্ট্রিটে নিজের বাড়িতে ইয়াহিয়া তখনো গৃহবন্দী। রাস্তায় কাওয়াসজিকে দেখে তিনি হাত নেড়ে চিৎকার করে বলেছিলেন, ‘এই কাওয়াসজি, আপনি আমাকে ভুট্টোর জেলখানা থেকে বের করেছিলেন। এখন এখান থেকে বের করেন।’
‘কঠিন,’ কাওয়াসজি বলেছিলেন, ‘কিন্তু হাল ছেড়ে দেবেন না। ধৈর্য ধরেন, তাঁর পড়ে যেতে আর বেশি দেরি নেই।’
ভুট্টো সম্পর্কে ইয়াহিয়া তাঁর দিনপঞ্জিতে লিখেছেন, ‘আমার বাঙালি মন্ত্রী ড. জি এইচ চৌধুরী তাঁর বইতে লিখেছেন, “পাকিস্তান আর পাওয়ার—এ দুই ‘পি’-এর মধ্য থেকে তাঁকে (ভুট্টো) বেছে নিতে হয়েছে একটা। তিনি বেছে নিয়েছেন শেষেরটা। আমার অর্থমন্ত্রী নওয়াব মুজাফ্ফর খিজিলবাশ একবার আমাকে বলেছিলেন, তাঁর এক বিদেশি বন্ধু, যিনি নামকরা মনোবিশারদ, তিনি তাঁকে বলেছিলেন যে এই লোকটা (ভুট্টো) যদি এক বছরের মধ্যে ক্ষমতায় যেতে না পারে, তাহলে সে পাগল হয়ে যাবে। আমি দোয়া করি, নিজের ক্ষমতার ক্ষুধা মেটানোর জন্য পাকিস্তান ভাঙার চেয়ে সে যেন পাগলই হয়ে যায়।’”
ইয়াহিয়া তাঁর দিনপঞ্জিতে বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে ভুট্টো সম্পর্কে লিখেছেন, ‘শোরা মুজিবুর রহমানকে এমন মাত্রায় ঘৃণা করতেন যে ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে আমি যখন ইরানি রাজতন্ত্রের রজতজয়ন্তী উৎসবে যোগ দিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম, তখন তিনি আমাকে সামরিক আদালতে মুজিবের মামলার কার্যক্রম শেষ করে তাঁকে শেষ করে দিতে বলেন। আমি তাঁকে বলি, আদালতে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারি না। তখন তিনি আমাকে বলেন, ইরানে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানেরা মুজিবকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আমার ওপর সব ধরনের চাপ প্রয়োগ করবেন। তাই আমার উচিত তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ নেওয়া এবং মুজিবকে ঝুলিয়ে দেওয়া। আমাদের দেশের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতা, যিনি নিজেকে গণতন্ত্রী বলে দাবি করেন, দাবি করেন যে তিনি জনগণের নেতা, তাঁর মুখে এ ধরনের কথা শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে যাই।
‘১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর আমি যখন তাঁর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করছিলাম, তখন তাঁকে বলি যে সামরিক আদালতের (মুজিবের মামলার) রায় ও আনুষঙ্গিক নথিপত্র পাওয়া গেছে এবং সেগুলো আইন মন্ত্রণালয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা হচ্ছে। মন্ত্রণালয়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ হওয়ার আগে তো কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। অথচ তিনি (ভুট্টো) জাতির সামনে কীভাবেই না বললেন যে আমি মুজিবের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছি, আর তিনি এসে তাঁকে বাঁচিয়েছেন! মিথ্যা! মিথ্যা! মিথ্যা! অবশ্য এ রকম একজন ঘাগু মিথ্যুকের কাছ থেকে অন্য আর কী প্রত্যাশা করার ছিল? সামরিক আদালতের দেওয়া ওই মামলার নথিপত্রগুলো নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে কাজ চলছে, সেগুলো খতিয়ে দেখলেই সত্যটা বেরিয়ে আসবে, কোন তারিখে কোন সময়ে কী করা হয়েছে।
‘মজার ব্যাপার হলো, তিনি (ভুট্টো) যখন মুজিবকে বলেন যে ইয়াহিয়া তাঁকে ফাঁসিতে ঝোলাতে চেয়েছেন, আর ভুট্টো তাঁকে বাঁচিয়েছেন, ভালোমানুষ মুজিব ভুট্টোর এই কথা বিশ্বাস করেছেন।
>‘অথচ তিনি (ভুট্টো) জাতির সামনে কীভাবেই না বললেন যে আমি মুজিবের মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিয়েছি, আর তিনি এসে তাঁকে বাঁচিয়েছেন! মিথ্যা! মিথ্যা! মিথ্যা! অবশ্য এ রকম একজন ঘাগু মিথ্যুকের কাছ থেকে অন্য আর কী প্রত্যাশা করার ছিল?’
‘ঘটনাক্রমে মুজিবকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন শুধু এক ভুট্টো নন। আরও আগের দিকে, (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে) ল্যাংড়া নুরুল আমিন ও মাহমুদ আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে এ দুজনই আমাকে বলেছিলেন, আমি মুজিবকে শেষ না করা পর্যন্ত তাঁরা পাকিস্তান-পসন্দ
ও ইসলাম-পসন্দ বাঙালিদের সামলাতে পারছেন না। উত্তরে আমি তাঁদের বলেছিলাম, পাকিস্তানের রাজনীতিকদের চিন্তাধারা যদি এ রকমই হয়ে থাকে, যদি তারা পরস্পরকে শেষ করে দিতে চায়, তাহলে আল্লাহ যেন এ ধরনের রাজনীতিকদের হাত থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করেন।’
১৪ ডিসেম্বর প্রথম আলোয় প্রকাশিত সহকর্মী মিজানুর রহমান খানের ‘কোর্ট মার্শালে বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ভুট্টো’ শিরোনামের নিবন্ধে লেখা হয়েছে, মুম্বাইয়ের ইংরেজি ট্যাবলয়েড সাপ্তাহিক ব্লিৎ্জ-এর সম্পাদক রুস্তম করনজিয়া ‘বিশ্বাস করতেন’ যে ভুট্টো শেখ মুজিবকে অন্তত একবার প্রাণে বাঁচিয়েছিলেন ‘ইয়াহিয়ার জল্লাদখানা’ থেকে। আসলে এটা যে ভুট্টো নিজেই দাবি করেছিলেন, তা আমরা ইয়াহিয়ার নিজের লেখা দিনপিঞ্জ থেকেই জেনেছি।
কিন্তু ড. গোয়েবলসের শিষ্য হিসেবে ভুট্টো ও ইয়াহিয়া কেউ কারও চেয়ে কম ছিলেন না। এই দুজনের কে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করতে চেয়েছিলেন আর কে তাঁকে রক্ষা করেছেন—এই প্রশ্নের সুরাহা এঁদের বক্তব্যের মধ্যে সম্ভবত নেই। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে, বঙ্গবন্ধু যখন পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে রুদ্ধ, সামরিক আদালতে তাঁর বিচার কার্যক্রম শুরুর সপ্তাহ দুই পরে টাইম সাময়িকীর ২৩ আগস্ট সংখ্যায় ‘পাকিস্তান: মুজিবস সিক্রেট ট্রায়াল’ শিরোনামের এক নিবন্ধের শেষে ডেভিড গ্রিনওয়ে লেখেন, ইয়াহিয়া সম্প্রতি তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকারী এক ব্যক্তিকে বলেছেন, ‘আমার জেনারেলরা (মুজিবের) বিচার ও মৃত্যুদণ্ড চান।’ কিন্তু তারপরও এ রকম একটা সাধারণ অনুভূতি আছে যে অখণ্ড পাকিস্তানের আশায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট মুজিবের জীবনরক্ষা করতেও পারেন। মুজিবকে জীবিত রাখার মধ্যেই পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম অংশের মধ্যকার বিচ্ছেদ এড়ানোর লক্ষ্যে আলোচনার শেষতম সুযোগটা খোলা থাকবে।
পাকিস্তানিদের হাতে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যু ঠেকানোর কৃতিত্ব আমেরিকান কূটনীতিকেরাও দাবি করেন। পাকিস্তানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত ছিলেন জোসেফ ফারল্যান্ড। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি, প্রায় প্রতিদিনই তাঁদের দেখা হতো এবং তাঁরা একসঙ্গে মদ খেতেন বলে জানিয়েছেন আমেরিকান অনুসন্ধানী সাংবাদিক জ্যাক এন্ডারসন। এন্ডারসন পেপারস-এর ২২২ পৃষ্ঠা থেকে জানা যাচ্ছে, ‘ফারল্যান্ড একবার ওয়াশিংটনে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, “যখন ইতিহাসের বইপত্র লেখা হবে, তখন দেখানো হবে যে যুক্তরাষ্ট্রের পলিসি ও পাকিস্তানে আমাদের স্থানীয় প্রচেষ্টার ফলেই মুজিব বেঁচে আছেন।” তিনি বলেন, ‘মুজিব গ্রেপ্তার হওয়ার পর আমি ইয়াহিয়ার সঙ্গে ঘন ঘন কথা বলতাম এবং প্রায়ই মুজিবের প্রসঙ্গ তুলতাম। আমি ইয়াহিয়াকে বলি, আমরা মনে করি, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের উভয় অংশের ভবিষ্যৎ স্থিতিশীলতার জন্য মুজিব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এই ব্যক্তিকে হত্যা না করার পরামর্শ আমি ইয়াহিয়াকে দিই। এবং অবশেষে গ্রীষ্মের শুরুর দিকে এক রাতে ইয়াহিয়া আমাকে বললেন, “আপনি আমাকে কনভিন্স করেছেন। তাঁকে (মুজিব) প্রাণদণ্ড দেওয়া হবে না।”’
প্রকৃতপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রক্ষা করেছিল বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি। স্নায়ুযুদ্ধের দুই প্রতিপক্ষ শিবির বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যেভাবে জড়িয়ে পড়েছিল, এবং সেখানে মুক্তিকামী বাঙালির জাতির নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমানের যে গুরুত্ব সব ক্রীড়নক মহলে অনুভূত হয়েছিল, তাতে তাঁকে বিচারের নামে হত্যা করা পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। অতটা অবিমৃশ্যকারী তারা হতে পারেনি।
মশিউল আলম: সাংবাদিক৷
[email protected]