সাংসদ পদে এত মধু!
বাংলাদেশে নির্বাচনে ভোটাররা অনেক আগেই অপাঙ্ক্তেয় হয়ে গেছেন। নির্বাচন এলে প্রার্থীরা আর ভোটারকে তোয়াজ করেন না। খোঁজেন না। ভাবেন, একবার মনোনয়নপত্র বাগিয়ে নিতে পারলেই মকসুদে মঞ্জিলে পৌঁছানো যাবে; বিশেষ করে যিনি ক্ষমতাসীন দলের মনোনয়ন পাবেন, তাঁর জয় ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য কারও নেই।
অনেক দূরে না গিয়ে নিকট অতীতের একটি উদাহরণ দিলেই পাঠকের কাছে বিষয়টি খোলাসা হবে। কক্সবাজার-৪ আসনের সাংসদ ছিলেন আবদুর রহমান ওরফে বদি। ইয়াবা ব্যবসার সঙ্গে তাঁর নাম আসায় ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তাঁকে লোকলজ্জা কিংবা অন্য কারণে হোক মনোনয়ন দেয়নি। মনোনয়ন দিয়েছে তাঁর স্ত্রী শাহীন আক্তারকে। তিনি একজন গৃহবধূ। কোনো দিন রাজনীতি করেননি। তাঁর নির্বাচনী প্রচারের কাজটিও করেছেন স্বামী আবদুর রহমান। এরপরও তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছেন। স্বামীর খড়ম হাতে নিয়ে সাংসদগিরি করছেন। বাংলাদেশের রাবড়ি দেবী।
বদির প্রসঙ্গটি মনে এল পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচনের তোড়জোড় দেখে। এই আসনের সাবেক সাংসদ ও ভূমিমন্ত্রী শামসুর রহমান শরীফ মারা গিয়েছেন গত ২ এপ্রিল। নির্বাচন কমিশন জনগণের ভোটাধিকার রক্ষা করতে না পারলেও করোনার মধ্যে লোকদেখানো উপনির্বাচন করে সংবিধান সমুন্নত রাখতে বদ্ধপরিকর। পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচনের তারিখ এখনো ঘোষিত হয়নি। এরপরও দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ মনোনয়ন ফরম বিক্রি শুরু করে দিয়েছে। তৎপর হয়েছে অন্যান্য দলও।
প্রথম আলোর পাবনা প্রতিনিধি সরোয়ার মোর্শেদের প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশীর সংখ্যা দেড় ডজনের মতো। এর মধ্যে সাবেক সাংসদের পরিবার থেকেই পাঁচজন—প্রয়াত মন্ত্রীর স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, মেয়ের স্বামী ও সাংসদের খালাতো ভাই। তাঁরা প্রত্যেকে নিজেকে যোগ্যতম প্রার্থী মনে করেন। অনেকটা লটারির মতো। যেকোনো একজন মনোনয়ন পেলে পরিবারেই থেকে যাবে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে আরও জানা যায়, আসনটি শূন্য ঘোষণার পরই উপনির্বাচনে মনোনয়ন পেতে মাঠে নেমেছেন শামসুর রহমান শরীফের স্ত্রী ও ঈশ্বরদী উপজেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কামরুন নাহার শরীফ। তিনি মনোনয়ন প্রত্যাশা করে পোস্টার-ব্যানারে ভরে দিয়েছেন নির্বাচনী এলাকা। পাল্টা পোস্টার-ব্যানার টাঙিয়ে মনোনয়ন প্রত্যাশা করেছেন তাঁদের বড় ছেলে ও ঈশ্বরদী উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য গালিবুর রহমান শরীফ। তবে মাকে আসন ছাড়তে রাজি নন তিনি। অন্যদিকে, মা ও ভাইকে টপকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বড় বোন ও জেলা আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক মাহজেবিন শিরিন এবং তাঁর স্বামী ঈশ্বরদী পৌর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও ঈশ্বরদী পৌরসভার মেয়র আবুল কালাম আজাদ। একই দৌড়ে অংশ নিচ্ছেন শামসুর রহমান শরীফের খালাতো ভাই এবং জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বশির আহম্মেদ।
ছেলে গালিবুর রহমান শরীফ বলেন, ‘আমি ঈশ্বরদী-আটঘরিয়া আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছি। সবাই আমাকে সমর্থন দিচ্ছেন।’ বাবা মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে তিনি কমিটিতে এসেছেন। গালিবের মা কামরুন নাহার শরীফ বলেন, ‘মনোনয়ন চাওয়ার অধিকার আমার আছে। দলেও অবস্থান ভালো। আমি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।’ গালিবের বোন মাহজেবিন শিরিন বলেন, ‘আমার বাবা ঈশ্বরদী-আটঘরিয়ায় ব্যাপক উন্নয়ন করেছেন। তিনি উন্নয়নের আরও অনেক স্বপ্ন বুনেছিলেন। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতেই আমি মনোনয়ন প্রত্যাশা করছি।’ তাঁদের যেকোনো একজন মনোনয়ন পেলে পরিবারেই সাংসদ পদটি থেকে যাবে।
শরীফ পরিবারের বাইরে আরও প্রায় এক ডজন আওয়ামী লীগ নেতা মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন। তাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা ও দুদকের সাবেক কমিশনার শাহাবুদ্দিন চুপ্পু, ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এস এম নজরুল ইসলাম, জেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি রেজাউল রহিম, পাবনা পৌরসভার মেয়র কামরুল হাসান, আটঘরিয়া পৌরসভার মেয়র শহিদুল ইসলাম, সাবেক সাংসদ পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস, ঈশ্বরদী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুজ্জামান বিশ্বাস, উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি নায়েব আলী বিশ্বাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আইনজীবী রবিউল আলম ও মৎস্যজীবী লীগ কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক প্রকৌশলী আবদুল আলিম উল্লেখযোগ্য।
অন্যদিকে, ২২ বছর আগে হারানো আসনটি ফিরে পেতে চায় স্থানীয় বিএনপি। দলের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও জেলা বিএনপির আহ্বায়ক কমিটির আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান ও কেন্দ্রীয় বিএনপির সদস্য সাবেক সাংসদ সিরাজুল ইসলাম সরদার। জাতীয় পার্টি থেকে মনোনয়ন চাইবেন সাবেক সাংসদ মঞ্জুর রহমান বিশ্বাস ও জেলা জাতীয় পার্টির সাবেক সভাপতি হায়দার আলী।
এক উপনির্বাচনে এত প্রার্থী! সবাই নিজেকে সাংসদ হিসেবে দেখতে চান। কেন? এই প্রশ্নের আংশিক জবাব পাওয়া গেছে সাম্প্রতিক টিআইবির এক প্রতিবেদনে। তারা ৫০টি নির্বাচনী এলাকায় সাংসদদের জন্য থোক বরাদ্দ নিয়ে যে গবেষণা করেছে, তাতে দেখা গেছে, এসব প্রকল্পে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি, অনিয়ম ও অপচয় হয়েছে। কোনো জবাবদিহি নেই। তদারকি নেই। উন্নয়নকাজ হলো একটি প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া। কিন্তু সাংসদের নিজের কোনো অফিস নেই। লোকবল নেই। প্রকল্প ঠিক করেন তিনি, ঠিকাদার নিয়োগ করেন তিনি, বিল অনুমোদনও করেন তিনি। এত তিনির মধ্যে আসল কাজটিই হারিয়ে যায়। প্রথমে সাংসদদের থোক বরাদ্দ ছিল বছরে দুই কোটি টাকা। সেটি বাড়তে বাড়তে এখন ২০ কোটি টাকা। একজন সাংসদ পাঁচ বছরের জন্য নির্বাচিত হন। সে ক্ষেত্রে তিনি থোক বরাদ্দই পাবেন ১০০ কোটি টাকা। এর সঙ্গে লাল পাসপোর্ট। ন্যাম ভবন। আরও কত–কী। এক জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছুর প্রয়োজন হয় না।
এ কারণেই একটি উপনির্বাচনে প্রার্থিতা নিয়ে মা-ছেলের দ্বন্দ্ব। মা-মেয়ের যুদ্ধ। ভাই-বোনের মনোমালিন্য। প্রয়াত ভাইয়ের পরিবারের সঙ্গে খালাতো ভাইয়ের রেষারেষি। প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসছেন দুদকের সাবেক কমিশনার ও ডিজিএফআইয়ের সাবেক প্রধানও।
কয়েক দিন আগে প্রথম আলোর প্রধান শিরোনাম ছিল ‘স্বাস্থ্যের মধু খেয়ে মিঠু বিদেশে’। একটি উপনির্বাচনে একই দলের পক্ষে একই পরিবারের পাঁচজনসহ দেড় ডজন ব্যক্তির দৌড়ঝাঁপ দেখে মনে হলো শুধু স্বাস্থ্য বিভাগে নয়, সাংসদ পদেও ঢের ঢের মধু আছে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]