ইতিহাসকে হাতকড়া পরানো যায় না
সাম্প্রতিক ‘উই ক্যান্ট ব্রিদ’ এবং ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনের সময় যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও বেলজিয়ামে নিপীড়ক, দাস ব্যবসায়ী এবং বর্ণবাদীদের ভাস্কর্য উপড়ে ফেলা হয়েছে। কলম্বাসের ভাস্কর্যের মস্তক ছিন্ন হয়েছে। এডওয়ার্ড কলস্টোন ও রবার্ট মিলিগানের ভাস্কর্য ওপড়ানো হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে দুঃশাসনের অভিযোগে খোদ ব্রিটিশ জনগণই রবার্ট ক্লাইভের ভাস্কর্য সরিয়ে নেওয়ার আন্দোলনে নেমেছে। ১৯৮৭ সালে বার্লিন প্রাচীর ভেঙেছে সাধারণ মানুষ। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত কর্তৃত্ববাদের পতনের পর জনরোষ থেকে মুক্ত থাকতে পারেনি স্তালিন ও লেনিনের ভাস্কর্যও! সাদ্দামের ভাস্কর্যের প্রতিও জনরোষের বিস্ফোরণ ঘটেছিল। যদিও সব কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্র নেতৃত্বই যথেচ্ছ ইতিহাসবিকৃতি ঘটিয়েছিল, লাভ হয়নি। ইতিহাসকে হাতকড়া পরানো যায়নি।
স্যার জন আলেক্সান্ডার ম্যাকডোনাল্ডকানাডার প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রথম প্রধানমন্ত্রী। তিনি আধুনিক কানাডার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং কানাডীয় ইতিহাসের সর্বকালের সেরা প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন দীর্ঘ ১৯ বছর। তবু মন্ট্রিয়লে তাঁর বিশালাকৃতির ভাস্কর্যটি এখন জনঘৃণার কবলে। ২০১৮ সালে একদল কানাডীয় সেটি ভেঙে ফেলারও চেষ্টা করেছিল। প্রিন্স এডওয়ার্ড দ্বীপের রাজধানী শার্লোট টাউনসহ আরও দু-একটি স্থানেও কয়েকটি ভাস্কর্য আছে। সেগুলোকে জনসমাগমের স্থান থেকে জাদুঘরে সরিয়ে নিতে জোরদার আন্দোলন শুরু হয়েছে। তিনি নিন্দিত হচ্ছেন শুধু দুটি অন্যায্য সিদ্ধান্তের কারণে। এক. ১৮৮১ সালে কানাডীয় আদিবাসী শিশুদের জন্য আবাসিক স্কুল প্রতিষ্ঠার আইন করেছিলেন। সংসদে আদিবাসীদের ‘সভ্য করার উদ্যোগ নিয়েছেন’ ধরনের খানিকটা অসম্মানসূচক মন্তব্যও করেছিলেন। চার্চ পরিচালিত স্কুলগুলো শিক্ষাদানের চেয়ে আদিবাসী শিশুদের প্রতি অমানবিক আচরণ ও যৌন নির্যাতনের স্মারক হয়ে ওঠে। দুই. লুই রিয়েল নামের একজন ভিন্নমতাবলম্বীকে দেশদ্রোহের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করেছিলেন।
মহিরুহ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হওয়ার কারণে ১৯৫৪ সাল থেকে কানাডার ১০ ডলারের ব্যাংক নোটে জন ম্যাকডোনাল্ডেরছবি ছাপা হয়ে আসছিল। কিন্তু ইতিহাস তাঁকেও ক্ষমা করেনি। কাউকেই ক্ষমা করে না। হিটলার, মুসোলিনি, ফ্রাংক, স্তালিন, নরিয়েগা, চসেস্কু, মার্কোস—কতজনের কথাই বা বলা সম্ভব? দীর্ঘ ৬৪ বছর পর ২০১৮ সালের নভেম্বরে কানাডার নতুন ব্যাংক নোট থেকে জন ম্যাকডোনাল্ডের ছবি বাদ পড়ে। সেখানে স্থান পেলেন কৃষ্ণাঙ্গিনী ভিওলা দেজমন্ড। ভিওলা একেবারেই সাধারণ নারী। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে সম্মানিত করেছে। কারণ, তিনি বর্ণপ্রথার বিরুদ্ধে এবং সমানাধিকার ও মানবাধিকারের পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। সিনেমা দেখতে গিয়ে সাদাদের ও কালোদের পৃথক বসার আয়োজনের প্রতিবাদের মতো ছোট একটি ঘটনাই তাঁকে ইতিহাসে সম্মানের আসনে বসিয়েছে।
বিশ্বজুড়েই ইতিহাস স্বরূপে উদ্ভাসিত হচ্ছে। কানাডায় দেড় দশক ধরে ইতিহাস সংস্কার চলছে। অনেকগুলো রাস্তা ছিল দাস ব্যবসায়ী, আদিবাসী নিপীড়ক ও অন্য অন্যায্য আচরণকারী অভিজাতদের নামে। সেগুলো বদলে সাধারণ মানুষের নামে নামকরণ হচ্ছে। যাঁরাই মানবতার ও মানবিকতার জন্য, সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে কিছু কাজ করেছেন, তাঁদের নামে স্কুল, কলেজ ও রাস্তাঘাটগুলোকে বদলে নেওয়া হচ্ছে। ইতিহাস সংস্কারের কানাডীয় উদ্যোগটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, বেলজিয়াম, জার্মানিসহ দেশে দেশে জনগণকে ইতিহাসনিষ্ঠ ও কর্তৃত্ববাদবিরোধী হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করেছে।
আশির দশকে দুনিয়াজোড়া অগণতান্ত্রিক ও কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোর বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতির অভিযোগ ওঠে। হার্ভার্ডসহ বিশ্বসেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ইতিহাস-গবেষকেরা আশঙ্কা জানালেন যে চারটি ইতিহাসবিকৃতি অহরহই হচ্ছে। এক. রাষ্ট্র পরিচালকদের মিথ্যা স্তুতি বন্দনা। দুই. অন্যায়-অপকর্ম ও দুর্নীতির ইতিহাস প্রকাশে বাধা ও নিষেধাজ্ঞা। তিন. স্কুল-কলেজের পাঠ্যবইগুলোতে মিথ্যা ও বানোয়াট ইতিহাস। চার. সংবাদপত্রসহ যোগাযোগমাধ্যমগুলোর তথ্যপ্রবাহে রাষ্ট্রীয় বাধা। তাঁরা আশঙ্কা করেন যে ভুল ইতিহাস ছড়িয়ে পড়বে কোটি কোটি মানুষের মগজে। আরেক দল বলল, ইতিহাসকে ছাইচাপা দিয়ে রাখা দুঃসাধ্য। ভিন্নমতের মানুষকেই শুধু হাতকড়া পরানো সম্ভব। ইতিহাসকে পরানোর মতো কোনো হাতকড়া আবিষ্কৃত হয়নি। ইতিহাসকে হাতকড়া পরানো যায় না।
সেই সময় শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ফ্রাঙ্কলিন পার্কার সম্পূর্ণ নির্মোহ এবং পক্ষপাতমুক্ত একটি গবেষণার দায়িত্ব পেলেন। তিনি পাঠ্যবইতে ইতিহাসবিকৃতিকে তাঁর বিষয় করলেন। বিশ্ব তখনো দুই মেরুতে বিভক্ত। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তাই তিনিও তাঁর বিখ্যাত গবেষণাটির সোজাসাপ্টা বিষয় করলেন, ‘ইউএসএ-ইউএসএসআর টেক্সট বুক ডিস্টর্শান্স’ (মার্কিন-সোভিয়েত পাঠ্যবই বিকৃতি)। সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদনটিতেই পার্কার প্রমাণ দেখালেন যে সোভিয়েত ইউনিয়নে পাঠ্যবই ইতিহাসবিকৃতিতে ঠাসা। সোভিয়েত বলয়ের দেশগুলোও একই দোষে দুষ্ট। সেই সময়ই জানা যায় যে পাকিস্তান ও ভারতের অসংখ্য বইয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধও শুধুই ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’। পাকিস্তানের ইতিহাসে লেখা ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’, ভারতের ইতিহাসে ‘সম্পূর্ণ কৃতিত্বই ভারতের’। পাকিস্তানের সামরিক শাসনকে দায়ী করা গেলেও গণতান্ত্রিক ভারত কেন একই পথে নামল, সেটা এক বড় প্রশ্ন।
রাশিয়ার প্রগতি প্রকাশনের বই ছিল আমাদের বাল্য ও যৌবনকালের সঙ্গী। উন্নত মানের কাগজ। মনকাড়া অলংকরণ। অসাধারণ বাঁধাই ও অঙ্গসৌষ্ঠব। রাশিয়ান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র থেকে নিখরচায় এবং নীলক্ষেত থেকে অল্প দামে কেনা যেত। গল্পে গল্পে ইতিহাস পাঠ করতাম। রাশিয়ার অভ্যন্তরে উন্নয়নের ও সমাজ-পরিবর্তনের ইতিহাস পড়তে নেমে জেনেছিলাম ইউক্রেনের কুলাক বা ধনী ভূমি-মালিকেরা সাগ্রহে নিজেদের কৃষি খামারগুলোকে সমবায়ে রূপান্তর করেছিলেন। যাঁরা সাম্যবাদী হননি, কিংবা বিরোধিতা করেছিলেন—বলশেভিকরা ও বঞ্চিতজন মিলে বিশ্বাসঘাতকদের কিছু শাস্তি দিয়েছিল।
আশির দশকে জানাজানি হচ্ছিল যে কুলাকদের নৃশংসভাবে দমন করা হয়েছে। ১৯৮৫ সালে সোভিয়েত লাইফ বইয়ে পিয়তর মিখাইলভের লেখা মার্সি ইন দা ইনফার্নো অব ওয়ার প্রবন্ধটি জানাল যে কুলাক এবং তাদের গবাদিপশুর ধ্বংসযজ্ঞ নাজিদের দখলীকৃত সোভিয়েত অঞ্চলগুলোর নৃশংসতাকেও বহুগুণ ছাড়িয়ে গিয়েছিল। নাজিরা ১৭ মিলিয়ন গো-মহিষ এবং ২৭ মিলিয়ন বকরি ধ্বংস করেছিল। অথচ শুধু ইউক্রেনেই কুলাকদের ৩২ মিলিয়ন গো-মহিষ এবং ৯৭ মিলিয়ন বকরি ধ্বংস করা হয়। প্রবন্ধটি প্রকাশের পরপরই পৃথিবীজুড়ে প্রগতি প্রকাশনীর শাখাগুলো বিভিন্ন ভাষায় পাল্টা ইতিহাস-গবেষণাগ্রন্থ ছাপতে থাকে। সেগুলোর বক্তব্য-কুলাক-দমন কল্পনাপ্রসূত অভিযোগ এবং মিখাইলভ সিআইএর দালাল। কানাডার প্রোগ্রেস বুক প্রকাশ করে ডগলাস টট্যল-এর আলোচিত গবেষণাগ্রন্থ ফ্রড, ফ্যামিন অ্যান্ড ফ্যাসিজম: দ্য ইউক্রেনিয়ান জেনোসাইড মিথ ফ্রম হিটলার টু হার্ভার্ড। কিন্তু এ রকম অসংখ্য গবেষণা দ্বারাও ইতিহাসের সত্যের স্বরূপে প্রকাশ আটকানো যায়নি। এবারের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলনও প্রমাণ করেছে কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রশক্তি যতই ইতিহাসবিকৃতি ঘটাক না কেন, ইতিহাসকে পরানোর মতো কোনো হাতকড়া কখনোই আবিষ্কৃত হয়নি। ইতিহাসকে কখনোই হাতকড়া পরানো যায় না।
হেলাল মহিউদ্দীন: নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর পিস স্টাডিজের রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও গবেষক