আতঙ্ক ও অপবাদ মোকাবিলা করব কীভাবে
মহামারি যে ব্যাপকতা আর অনিশ্চয়তা নিয়ে হাজির হয়, তাতে সমাজে নানা রকম আতঙ্ক ও স্টিগমা তৈরি হয়। স্টিগমার বাংলা হিসেবে আমরা এখানে ‘অপবাদ’ শব্দটি বেছে নিলাম। অতীতে প্লেগ, কলেরা, গুটিবসন্ত মহামারির সময় আতঙ্ক ও অপবাদের ঘটনা বিস্তর ঘটেছে। সাম্প্রতিক করোনা মহামারি ঘিরে বাংলাদেশেও জনমনে আতঙ্ক ও অপবাদের ঘটনাও ঘটছে। এদের বিচ্ছিন্ন ঘটনারূপে এড়িয়ে গিয়ে শুধু চিকিৎসা আর অর্থনৈতিক প্রণোদনা দিয়ে করোনা মহামারি মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। এই ভাবনা থেকে বাংলাদেশে করোনাকেন্দ্রিক আতঙ্ক ও অপবাদের চরিত্রটি বোঝার জন্য আমরা একটি সংক্ষিপ্ত গবেষণা করি বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের সহযোগিতায়।
আমরা আতঙ্ক ও অপবাদ বিষয়ে দুটি তাত্ত্বিক কাঠামোর পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান অবস্থাটিকে বুঝতে চেষ্টা করি। নৃবৈজ্ঞানিক গবেষণাপদ্ধতি ব্যবহার করে আমরা দেখি, মোটামুটি ছয়টি ধাপে করোনাকেন্দ্রিক আতঙ্ক ও অপবাদের বিকাশ ঘটেছে বাংলাদেশে। প্রথম ধাপটির নাম হতে পারে ভ্রান্ত নিরাপত্তাবোধ তৈরির চেষ্টা। এটি খেয়াল করা গেছে জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এ সময় চীন থেকে করোনা ইউরোপে তাণ্ডব চালানো শুরু করলে বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে এমন একটা ধারণা দেখা যায় যে এটি অন্য দেশের রোগ এবং আমরা এ থেকে নিরাপদ। অনেক ধর্মীয় বক্তা প্রচার করেন যে করোনা পশ্চিমাদের রোগ; এর সঙ্গে তাদের পাপাচার ও অনৈতিক জীবনযাপনের সম্পর্ক আছে। আবার কোনো কোনো চিকিৎসক ও বিজ্ঞানমনস্ক লোক প্রচার করেন যে আমাদের মতো উষ্ণ আবহাওয়ার দেশে করোনার জীবাণু বাঁচতে পারবে না। এভাবে একটা নৈতিক ও বৈজ্ঞানিক দূরত্ব তৈরি করার চেষ্টা চলে করোনার সঙ্গে। ফলে করোনাকে বাংলাদেশের বহু মানুষ নিজেদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ভাবার অবকাশটুকু পায়নি।
আতঙ্ক আনুষ্ঠানিকভাবে ছড়াতে শুরু করে ইতালিপ্রবাসীদের দেশে ফেরার ঘটনা দিয়ে। তাঁরা যখন হজ ক্যাম্পের কোয়ারেন্টিন এড়িয়ে নিজেদের বাসাবাড়িতে চলে যেতে থাকলেন, তখন মানুষ করোনার ঝুঁকি নিয়ে সত্যিকারভাবে সচেতন হতে শুরু করে। এ সময় প্রশাসন থেকে দুটো কাজ করা হয়: তাঁদের সবার হাতে কোয়ারেন্টিনের তারিখের একটা বিশেষ সিল দেওয়া হয় এবং তাঁদের গ্রামের বাড়িগুলোতে লাল পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। এভাবে অপবাদ বা স্টিগমা আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে। প্রশাসনিকভাবেও। এটা দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপে ভয়ের উৎস প্রবাসীরা এবং তাঁদের আলাদা করে ঝুঁকিপূর্ণ বর্গ হিসেবে শনাক্ত করার কারণে সমাজ তাঁদের অগ্রহণ করার নৈতিক বৈধতা পায়। প্রশাসনিক স্টিগমা বা অপবাদ এই ধাপে সামাজিক অপবাদের উৎস হিসেবে কাজ করে। পাড়ার চায়ের স্টলে, দোকানে প্রবাসীদের প্রবেশ নিষেধ—এই মর্মে ব্যানার টানানো হয়। বাইরে চলাচল করা প্রবাসীদের ওপর আক্রমণের ঘটনাও ঘটে। এটি করোনা আতঙ্ক ও অপবাদের তৃতীয় ধাপ।
মার্চের তৃতীয় সপ্তাহে করোনায় আক্রান্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রথম দুজনের মৃত্যু ঘটে। তাঁদের একজন দেশেই ছিলেন, যাঁর প্রবাসীদের সংস্পর্শে আসার কোনো ইতিহাস পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় করোনার ঝুঁকি মানুষের কাছে বাস্তব হয়ে ওঠে। এ–ও স্পষ্ট হয় যে করোনার সামাজিক সংক্রমণ ঘটে গেছে। এই সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমগুলোও করোনা বিষয়ে স্ববিরোধী, চাঞ্চল্যকর, অস্পষ্ট তথ্য ও বার্তা প্রচার করতে থাকে। সামাজিক মাধ্যমে গুজব ও ভুয়া তথ্য মহামারির আকার ধারণ করে। সামাজিক দূরত্বের মাপ নির্ধারণে দুই রকম বার্তা পাওয়া যায়। জীবাণুর চলাচল বিষয়েও নানামুখী বৈজ্ঞানিক প্রকল্পনা জানা হয়ে যায়। উপসর্গ বিষয়েও নিশ্চিত হওয়ার উপায় থাকে না। এটিও জানা হয়ে যায় যে করোনার কোনো চিকিৎসা নেই, অতীতের কোনো মহামারির সঙ্গে এর মিলও নেই। মরদেহ কবর দেওয়া নিয়েও জটিলতা দেখা দেয়। সংগত কারণেই জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে কোনো সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা মেলে না। এভাবে একটা ব্যাপক অনিশ্চয়তা সমাজে দেখা দেয় এবং তা থেকে দিশাহীন আতঙ্কের জন্ম হয়।
পঞ্চম ধাপটি শুরু হয় মার্চের শেষ থেকে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দেশব্যাপী ছুটি ঘোষণা করার মাধ্যমে। ঢাকা থেকে মানুষ দলে দলে গ্রামাঞ্চলে রওনা দিল। নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে করোনার ভীতির চেয়েও তীব্র হয়ে দেখা দিল জীবিকা হারানো ও ক্ষুধার ভয়। লকডাউনের মধ্যে পোশাক কারখানা খোলার ঘোষণা, আবার সদলবলে ঢাকামুখী মানুষের স্রোত। খড়ের কুটোর মতো উড়ে গেল সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক পরা কিংবা হাত ধোয়ার মতো জরুরি বার্তাগুলো। এই সময়ে দ্রুত হারে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা বাড়তে থাকে। কিন্তু চিকিৎসক, নার্সদের জন্য যথেষ্ট সুরক্ষা সরঞ্জাম না থাকায় চিকিৎসকেরা ভীত হয়ে পড়েন, কেউ কেউ কাজ থেকে বিরত থাকেন, বহু বেসরকারি ক্লিনিক ও হাসপাতাল বন্ধ করে দেওয়া হয়। করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার নানা ব্যর্থতার খবর প্রচারিত হতে থাকে। এমন ধারণা অনেকের মধ্যেই দেখা যায় যে করোনা হলে পুলিশ গ্রেপ্তার করে হাসপাতালে নিয়ে যাবে এবং হাসপাতালে গেলে মৃত্যু অবধারিত এবং মৃত্যু হলে মরদেহ আর কখনোই পরিজনেরা পাবেন না। সব মিলিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয় এবং ক্ষোভ আরও বাড়তে দেখা যায় এই পর্বে। ইতিমধ্যে অনেক মধ্যবিত্ত জীবিকা হারানোর ফলে দরিদ্র হয়ে পড়ার ভয়ে ভীত হয়ে পড়ে। উচ্চবিত্তদের মধ্যে এমন ভয়ও দেখা যায় যে হয়তো অভাবী মানুষ অচিরেই ক্ষুধার তাড়নায় তাদের বাড়িঘর আক্রমণ করবে।
অন্যদিকে ঢাকার বাইরে এমন ব্যাপক জনগোষ্ঠীও দেখা যাচ্ছে, যারা এই করোনাকে বিশেষ তোয়াক্কা করছে না। এর মধ্যেই বড় বড় জমায়েত হয়েছে, যেমন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একজন ধর্মীয় নেতার জানাজায় লক্ষাধিক মানুষের সমাগম ঘটে। গ্রামাঞ্চলে এখনো অনেক মানুষ মনে করছে, সমস্যাটি ঢাকা শহরের, তাদের নয়। এক দল মানুষের এই ভয়হীনতা আবার আরেক দল মানুষের ভয়ের কারণ হয়ে উঠছে। এই ধাপে এসে ভয়ের চেহারা সর্বব্যাপী হয়ে উঠেছে। ভয় মানুষকে সন্দিগ্ধ করে তুলছে, অচেনা কাউকে দেখলেই সে বিরূপ আচরণ করছে। এই পর্বে করোনা সন্দেহে নিজের প্রিয়জনকে পথে-জঙ্গলে ফেলে আসা, ভাড়াটেকে উচ্ছেদ করা, করোনা রোগীর বাড়ি আক্রমণ করা, চিহ্নিত করোনা রোগীর হাসপাতাল বা বাড়ি থেকে পালিয়ে যাওয়া, করোনাজনিত মৃত্যু গোপন করা, করোনার সেবা দিয়ে বাড়ি আসা স্বাস্থ্যকর্মীকে গ্রামের প্রান্তে তালপাতার ছাউনিতে ফেলে রাখা ইত্যাদি ঘটনা ঘটেছে। পাড়ায় পাড়ায় সোশ্যাল পুলিশিং শুরু হয়ে গেছে, কেউ এমনকি প্যারাসিটামল কিনতে ফার্মেসিতে গেলেও তার বাড়ি গিয়ে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। এভাবেই অপবাদের সংস্কৃতি দৃঢ়মূল হয়ে ওঠে, পারস্পরিক সম্পর্ক ও বোঝাপড়া নষ্ট হয়। বাংলাদেশে আতঙ্ক ও অপবাদ এই ষষ্ঠ ধাপে আছে বলে আমরা মনে করছি।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, কীভাবে আতঙ্ক ও অপবাদ প্রশাসনিক কাঠামো থেকে ক্রমে সমাজকাঠামোর ভেতর সঞ্চারিত হয়ে একটা তরল ভয়ের আবহ তৈরি করেছে। এটা যাতে সমাজে স্থায়ী ক্ষত তৈরি না করতে পারে, সে জন্য অতি দ্রুত রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিপর্যায়ে নানা পদক্ষেপ নেওয়া দরকার। আতঙ্কের উৎস প্রায়ই ভ্রান্ত ধারণা থেকে। সমন্বিত ও বিশেষায়িত উপায়ে করোনাবিষয়ক সুনির্দিষ্ট তথ্য মানুষের কাছে পৌঁছানো প্রয়োজন।
অপবাদের ঘটনার বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, গণমাধ্যমে সতর্কতার সঙ্গে স্টিগমাবিরোধী ব্যাপক প্রচারণা প্রয়োজন। স্থানীয় পর্যায়ে প্রশাসন, রাজনীতিবিদ ও স্বেচ্ছাসেবীর সমন্বয়ে অপবাদ নিরসনে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। যিনি অপদস্থ হয়েছেন, তাঁকে মানসিকভাবে সাহায্য করা অত্যন্ত জরুরি। যাঁরা অপবাদ দিচ্ছেন, প্রয়োজনে তাঁদের শনাক্ত করা জরুরি। করোনায় আক্রান্তদের মনোবল অটুট রাখতে সহায়তা করতে হবে।
করোনা অবশ্যই ভীতিকর, কিন্তু মানুষ এর চেয়ে বড় বড় যুদ্ধে জয়ী হয়ে এসেছে, ইতিহাসের এই শিক্ষা মনে রাখতে হবে। না হলে এই মহামারি আমাদের ঘাড়ে আরও শক্ত হয়ে চেপে বসবে। আমরা পালাতে থাকব চিকিৎসা নেওয়া থেকে, চিকিৎসা দেওয়া থেকে, সহায়তা করা থেকে। ফলে করোনা একেবারে খালি মাঠ পেয়ে যাবে!
ড. শাহাদুজ্জামান: লেখক ও যুক্তরাজ্যের ইউনিভার্সিটি অব সাসেক্সের জনস্বাস্থ্য গবেষক।
ড. সুমন রহমান: লেখক ও ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশের যোগাযোগ গবেষক।
এই গবেষণায় সহযোগিতা করেছেন: সুমন মোল্লা, সুরবি প্রত্যয়ী, সাদ্দিফ সোহরাব, পাভেল আহমেদ, মালিহা মারিয়াম, মোশারফ হোসেন, অলীক বিশ্বাস ও সুমাইয়া আক্তার