উৎপাদন বাড়ানো ও বিপণনব্যবস্থা সচল করা জরুরি
করোনাভাইরাসের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি। কর্মহীন হয়ে পড়েছ অগণিত মানুষ। সচ্ছল অনেক পরিবারও আজ সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই।
বেশ কয়েক বছর ধরে আমাদের ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। সম্প্রসারিত হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তাবলয়। হতদরিদ্রের সংখ্যা কমে আসছিল। নিজের আয়ে চলার মর্যাদা ভোগ করছিল অনেকেই। হঠাৎ বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটল। অর্থনীতি বিপর্যস্ত।
গত ২৬ মার্চ থেকে শুরু সাধারণ ছুটি, অবরুদ্ধ দশা বা লকডাউন। কিছু ক্ষেত্রে শিথিল করা হলেও, শেষ হয়নি। শেষ হওয়ার কথা ৫ মে। পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটলে ভিন্ন সিদ্ধান্ত হতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে জীবিকা হারা মানুষকে সরকার সহায়তা দিচ্ছে। বেসরকারি সংস্থা ও ব্যক্তিগত পর্যায়েও ত্রাণ-সহযোগিতা দেওয়া হচ্ছে। তবে শুধু চাল আর ডালেই তো চাহিদা সীমাবদ্ধ থাকে না। যারা নিজের আয়ে একটু ভালো জীবন যাপন করছিল, তাদের অনেকে আজ নগদ টাকার অভাবে দিশেহারা। সরকারের পক্ষে সব ধরনের ভোগ্যপণ্য সরবরাহ করা সম্ভব নয়। তবে সরকার মানুষের আয়রোজগারের পথ খুলে দিতে পারে, যাতে মানুষ নিজের আয়ে জীবন চালাতে পারে।
লকডাউনের প্রয়োজনীয়তা আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু রুজি হারানো লোকদের দিকটিও বিবেচনায় নিতে হয়। সরকার ধীরে ধীরে হলেও সেদিকেই যাচ্ছে। আর তা করতেও হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা; সে জন্য বাজারকে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয় পক্ষের জন্য অনুকূল করতে হবে। এতে অনেক প্রতিবন্ধকতা আছে। আগেও ছিল, লকডাউনের কল্যাণে অনেক গুণ বেড়েছে। মূল সমস্যা ব্যবস্থাপনা। আমাদের বাজার ব্যবস্থাপনা এখন ক্রেতা বা বিক্রেতা কারোর সহায়ক নয়।
খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। চালের বিষয়টিই মুখ্য। চলতি বোরো মৌসুমে হাওরে ধান কাটা চলছে। এ মৌসুমে চালের উৎপাদন ২ কোটি টন। ৪০ লাখ টনই আসে হাওর অঞ্চল থেকে। এ ফসল যাতে কোনোভাবেই মার না যায়, তা নিশ্চিত করতে ‘ঘরে থাকো’ নীতির বিপরীতে ‘বাইরে এসো ও ধান কাটো’ নীতি চলছে। এটাই বাস্তবতা। স্থানীয় শ্রমিকসংকটের মুখে বাইরে থেকে শ্রমিকদের যেতে উৎসাহ ও প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দেশের এক ইঞ্চি জমিও যেন অনাবাদি না থাকে, সে বিষয়ে সচেতন থাকতে কৃষিজীবীদের সরকার আহ্বান জানাচ্ছে। ফসল ফলিয়ে চাষি লোকসান গুনতে চায় না। কিন্তু কয়েক বছর ধরে ধানচাষিদের ধারাবাহিক লোকসান চলছে। এবার পরিস্থিতি একটু ভালো হবে বলে মনে করা হচ্ছে। সবজি ও অন্যান্য আবাদ কিছুটা লাভজনক ছিল; কিন্তু এবার করোনার কারণে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। কৃষকদের এসব কৃষিপণ্য নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার অভাবে চাহিদা কমে যাওয়া এবং অনিয়মিত ও অপর্যাপ্ত সরবরাহ বাজারব্যবস্থায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে জনগণকে রক্ষা করতে বিভিন্ন বাজারের সময়সূচি বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখেও ক্রয়-বিক্রয় গতিশীল রাখা যায়।
সবচেয়ে বেশ বিঘ্ন ঘটার কথা জানা যায় পাইকারি বিপণন ও সরবরাহব্যবস্থায়। শহরের আড়তগুলো খুচরা পর্যায়ে চাহিদা কমায় আমদানি কমিয়ে দিয়েছে। অন্যদিকে কোনো কোনো ছাত্র-যুব সংগঠনের চাঁদাবাজি মফস্বলের মোকামগুলো থেকে মাল আনা কঠিন করে ফেলছে। ক্ষেত্রবিশেষে যুক্ত হচ্ছে কোনো না কোনো আইন প্রয়োগকারী সংস্থার চাঁদা। পর্যাপ্ত পাইকারের সমাগম না থাকায় মোকামে আনা পণ্য থাকছে অবিক্রীত। যানবাহনের অভাবে ও চলাচলে বিঘ্ন ঘটায় খুচরা পর্যায়ে পণ্যের মাশুল দেয় মূলত ক্রেতা। বিক্রেতা যাকে পায়, তাকেই ঠকিয়ে লাভ করতে চায়। অন্যদিকে ক্রেতার অভাবে উৎপাদনকারীরা নামমাত্র দামে পণ্য ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ফলে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। লাভবান হয় মধ্যস্বত্বভোগীরা।
লকডাউনের কারণে কৃষিপণ্যের পরিবহন বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা নয়, কিন্তু হচ্ছে। পচনশীল কৃষিপণ্য পচে যাচ্ছে। যশোর, ঝিনাইদহের ফুলচাষিরা উৎপাদন পর্যায়েই করোনার কারণে বাংলা নববর্ষে ১৫০ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে বলে জানা যায়। ফুলের বাজার দ্রুত ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে এটিকে কিছুটা ধরে রাখতে না পারলে আবার গড়ে তোলা ব্যয় ও সময়সাধ্য হবে। এসব বিষয়ে সরকারের যে প্রণোদনার ঘোষণা রয়েছে, তা দ্রুত বাস্তবায়ন করা দরকার। বিলম্বে প্রত্যাশিত ফল পাওয়া যাবে না।
একটি ইংরেজি দৈনিকের খবর অনুযায়ী, দেশে অচিরেই হাঁস-মুরগির ডিমের সংকট দেখা দেবে। চাহিদার তুলনায় অপ্রতুলতা ও সরবরাহব্যবস্থায় বিঘ্নের কারণে এগুলোর দাম অস্বাভাবিক কমে যায়। ফলে খামারিরা উৎপাদন কমিয়ে দেয়। এক দিনের বাচ্চার উৎপাদনব্যয় খরচ ৩২ টাকা, কিন্তু তা বিক্রি করতে হয়েছে ১-২ টাকায়। হাজার হাজার বাচ্চা মাটিতে পুঁতে ফেলা হয়েছে। পোলট্রি বাচ্চার সাপ্তাহিক উৎপাদন এখন ১ কোটি ৪০ লাখ থেকে কমে ৭০-৭৫ লাখে নেমেছে। ডিমের দামও বেশ কম। পোলট্রি শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই ক্ষতিগ্রস্ত।
তবে পোলট্রি পণ্যের চাহিদা অচিরেই বাড়বে। তখন দাম অনেক বেড়ে যাবে। গরুর দুধের উৎপাদন খরচ লিটারপ্রতি ৫০-৬০ টাকা। কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ২০-২৫ টাকায় বা আরও কমে। অতিরিক্ত দুধ, গুঁড়া দুধ, ঘি, মাখন, পনির ইত্যাদি উৎপাদন করার প্রযুক্তি আমাদের সীমিত। এ ক্ষেত্রে সরকারের জোরালো প্রচেষ্টা থাকলে বিপর্যয় কিছু কমানো যেত। প্রণোদনার অর্থ খামারিদের দ্রুত প্রাপ্তির ব্যবস্থা করা দরকার।
একই দুর্দশায় পড়েছেন মাছচাষিরাও। শহর-গঞ্জে মাছ দুষ্প্রাপ্য হলেও খামারে দাম পড়ে গেছে; কোথাও নেমেছে অর্ধেকে। মাছের উৎপাদন খরচও উঠছে না। অথচ এ মৌসুমে মৎস্যচাষিদের নতুন পোনা মজুত করার কথা। পাওনা মেটানো হয় মাছের খাবার ও ওষুধ সরবরাহকারীদের। মূলত বাজারব্যবস্থার ওপর অযাচিত হস্তক্ষেপের ফলে এমনটা ঘটেছে। করোনা মোকাবিলায় আমাদের ঘরে থাকার প্রয়োজনীয়তা উপেক্ষা করা যায় না। তবে খামার শ্রমিক ও সরবরাহব্যবস্থায় এমনকি ভোক্তাপর্যায়ে এ ধরনের কঠোর বিধিনিষেধে পড়লে সরবরাহব্যবস্থা বিপর্যস্ত হবে। তাই হয়েছে। খামারিদের পাশাপাশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভোক্তারা। তাদের মাছ কিনতে হচ্ছে চড়া দামে। মাছের সরবরাহব্যবস্থাও বিভিন্ন পর্যায়ে বিঘ্নিত হচ্ছে।
করোনা মহামারি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা ছাড়াও অর্থনীতি ও সমাজে বহু ক্ষতি সাধন করে চলেছে। তবে লড়ে যাচ্ছে মানুষ। একপর্যায়ে মানুষই জয়ী হবে, এমন আশা সবার। এখন ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে দ্রুত আবার দাঁড় করাতে এখন থেকেই উদ্যোগ প্রয়োজন। সরকারের ঘোষিত আর্থিক প্রণোদনার দ্রুত ও সহজ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। আমরা এখনই সক্রিয় হলে বিশেষত কৃষি খাতে প্রণোদনার ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে দ্রুত। আর আমরা গা-ছাড়া হলে তার নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। বেশি বেশি উৎপাদনের জন্য আহ্বান জানানো যৌক্তিক ও সময়োচিত। তবে উৎপাদিত পণ্যের লাভজনক বিপণনব্যবস্থা নিশ্চিত করাও সরকারের সাধ্যাতীত নয়। এসব ক্ষেত্রে বাধাবিঘ্ন অপরাধের সমতুল্য মনে করতে হবে। সহায়তা করতে সরকারের সব সংস্থাকে নির্দেশ দিলে পরিস্থিতি ইতিবাচক দিকে যাবে। আর তা করতে হবে দ্রুতই। ন্যায্যমূল্যে বিপণনের নিশ্চয়তা দেখতে না পেলে উৎপাদনকারীরা গুটিয়ে নেওয়া হাত আবার কাজে লাগাতে দ্বিধান্বিত থাকবেন।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব