অবিশ্বাস্য বলা যাবে না। কারণ, বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল এর আগেও বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পর্যন্ত গেছে। সেদিক থেকে বলতে হয়, শীর্ষে যাওয়ার সিঁড়িতেই তারা ছিল। তবে বিশ্বসেরা হওয়ার সাফল্য অবিস্মরণীয় তো বটেই!
বিশ্বকাপের মতো খেলায় সেমিফাইনাল থেকে ফাইনাল, ফাইনাল থেকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের সিংহাসনে বসাটা আপাতদৃষ্টিতে দুটি মাত্র ম্যাচের ব্যাপার মনে হলেও এই দুই ম্যাচের চাপ অনন্ত। সবচেয়ে বড় বিষয়, বাংলাদেশের যুবারা দক্ষিণ আফ্রিকায় ফাইনালে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে ভারতের মতো দলকে হারিয়ে। ভারতের যুবদল চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন, এবারের ফাইনাল তাদের টানা তৃতীয় ফাইনাল। বিশ্বকাপ ফাইনালের চাপ কেমন, তা তাদের অজানা নয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের দলটি তো বটেই, গোটা দেশের ক্রিকেটের জন্যই বিশ্বকাপ ফাইনালের চাপ নেওয়াটা ছিল নতুন এক অভিজ্ঞতা।
বাংলাদেশের মানুষকে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের গৌরবে ভাসানোর জন্য আকবর আলী ও তাঁর বিশ্বজয়ী দলকে প্রাণঢালা অভিনন্দন। তবে তাঁদের যা কীর্তি, তার জন্য শুধু অভিনন্দনই যথেষ্ট নয়। আকবর, শরিফুল, মাহমুদুলরা তাঁদের কাজ করেছেন। তাঁদের ভবিষ্যৎ পথকে মসৃণ করতে এবার আমাদেরও কিছু করার আছে।
বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গন যখনই নতুন কোনো সাফল্যে উদ্ভাসিত হয়, তখনই আমরা অনুধাবন করি যে আমাদের আরও অনেক কিছু করা উচিত। খেলা এবং খেলোয়াড়দের মান বাড়াতে আমাদের নতুন নতুন উদ্যোগ ও কর্মসূচি নিতে হবে। খেলার মাঠ ও আধুনিক সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে ইত্যাদি, ইত্যাদি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী করি?
অপ্রিয় সত্যটি হচ্ছে, আমরা শুধু সাফল্যকেই মনে রাখি, সাফল্যের পরের উপলব্ধি আর প্রতিশ্রুতিগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধুলার আস্তরণে ডুবে যায়। আমরা খেলোয়াড়দের পুরস্কৃত করি, তাঁদের অনুপ্রাণিত করতে এর নিশ্চয়ই দরকার আছে; কিন্তু এই অনূর্ধ্ব-১৯ দলের কথা যদি বিবেচনায় নেওয়া হয়, তবে আমাদের আসলে কী করা উচিত? যুবাদের খেলাটা যেন সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরও শাণিত হয়, দলের প্রত্যেক খেলোয়াড় যেন ভবিষ্যতেও লাল-সবুজ দলের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন, বড় হয়ে দেশকে এনে দিতে পারেন বড়দের বিশ্বকাপ—এটাই হওয়া উচিত আমাদের মূল লক্ষ্য। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে তা মাথায় রেখেই কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া উচিত। আকবর-শরিফুলদের দেখে অনুপ্রাণিত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ক্রিকেটাররা যেন তাঁদের স্বপ্নকে সত্যি করতে খেলার সুষ্ঠু পরিবেশ পান, নিশ্চিত করতে হবে সেটিও।
ভালো ক্রিকেটার হিসেবে বেড়ে ওঠার জন্য সবার আগে চাই খেলার সুষ্ঠু পরিবেশ। খেলার জন্য খোলা মাঠ আর খেলার আবহে থাকতে হবে বিশুদ্ধ-নির্মল হাওয়া। কয়েক বছর ধরে আমাদের ঘরোয়া ক্রিকেট যেভাবে পেশিশক্তির কাছে পরাস্ত, পাতানো ম্যাচ আর পক্ষপাতমূলক আম্পায়ারিংয়ের বিষে বিষাক্ত, সে রকম নির্মল হাওয়া উঠতি ক্রিকেটাররা কোথায় পাবেন! বরং শুরুতেই তাঁরা এমন সব বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন, তাতে খেলার প্রতি বিরূপ ধারণা চলে আসা অস্বাভাবিক নয়। তা ছাড়া, ক্রিকেটারদের উঠে আসার পথটাও এখন অনেক সংকীর্ণ।
একটা সময়ে ঢাকায় তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ের যে টুর্নামেন্টটি হতো, তাতে সারা দেশের ৫০০-৭০০ তরুণ ক্রিকেটার খেলার সুযোগ পেতেন। একাডেমি কাপেও ৩০০-৪০০ উঠতি খেলোয়াড়ের খেলার সুযোগ ছিল; কিন্তু এই দুটি টুর্নামেন্টের কোনোটিই এখন হচ্ছে না। তৃতীয় বিভাগ বাছাইয়ের এন্ট্রি ফি ৫ হাজার টাকা থেকে এক লাফে ৫ লাখ টাকা করে দেওয়ায় কয়েক বছর ধরে কোনো ক্লাব এতে অংশ নেয় না। এই সুযোগে লটারির মাধ্যমে চ্যাম্পিয়ন-রানার্সআপ ঠিক করে তৃতীয় বিভাগে তোলা হচ্ছে বোর্ড কর্মকর্তাদের নিজেদের দলকে। উঠতি তরুণ ক্রিকেটাররা বঞ্চিত হচ্ছেন প্রতিযোগিতামূলক খেলায় নিজেদের সামর্থ্যের জানান দিতে।
আকবরদের সাফল্যে আমরা উৎসব করব, উচ্ছ্বাসে ভাসব; কিন্তু ভবিষ্যতের খেলোয়াড়দের বেড়ে ওঠার সুষ্ঠু পরিবেশ আমরা নিশ্চিত করব—সেই প্রতিজ্ঞাও যেন আমরা করি।