দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে উদ্বেগজনকভাবে র্যাগিং অব্যাহত রয়েছে। অথচ এটা বন্ধে সংসদীয় সংবেদনশীলতা সম্পূর্ণরূপে অনুপস্থিত। সর্বশেষ জাতীয় কবি নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষার্থীর অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর বেরিয়েছে। কিন্তু অভিযুক্ত শিক্ষার্থীদের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। তাদের এই অপারগতায় তেমন কোনো বিস্ময় নেই। কারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে র্যাগিং কার্যত একটি নিত্যনৈমিত্তিক বিষয়।
এটা বোধগম্য যে র্যাগিং হলেই তার খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্রে ভুক্তভোগী ও তাঁর অভিভাবকেরা যতটা সম্ভব মুখ বুজে মেনে নেওয়ার চেষ্টাই করেন। কারণ, তাঁরা ভালো করেই জানেন, শিক্ষাজীবনের শুরুতেই একটা টানাপোড়েন দেখা দেওয়া এবং তাকে বয়ে বেড়ানো একটি অস্বস্তির বিষয়। এমনকি প্রতিবাদী হলে ক্ষেত্রবিশেষে তার কী পরিণতি হতে পারে, সেটাও দেশের তরুণসমাজের কাছে পরিষ্কার। বুয়েটের আবরার হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের সরকার বা সমাজের অভ্যন্তরে র্যাগিংবিরোধী বড় কোনো জাগরণ ঘটেছে, সেটা মনে করার কারণ নেই।
গত ১০ অক্টোবর শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি বলেছিলেন, সরকারের একার পক্ষে র্যাগিং বন্ধ করা সম্ভব নয়। এটা রোধ করতে হলে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। কিন্তু সমাজ রাজনৈতিকভাবে বিভক্ত। এবং একটি বিভক্ত সমাজে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে র্যাগিংয়ের মতো সংকট মোকাবিলা সহজ নয়। সামাজিক আন্দোলন চাইলে বাক্স্বাধীনতার অবাধ অনুশীলন থাকতে হবে। শক্তিশালী নাগরিক সংগঠন থাকতে হবে। কিন্তু এটা অনস্বীকার্য যে দোষ বা ব্যর্থতা যারই হোক, নাগরিক ও সামাজিক সংগঠনগুলো দুর্বল।
র্যাগিং ও নারী নিগ্রহের মতো সামাজিক ব্যাধিগুলো প্রতিরোধে রাজনৈতিক সংগঠনগুলোর স্থানীয়ভাবে শ্রদ্ধাভাজন নেতারা কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক সংগঠনগুলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নীতিনৈতিকতা ও মূল্যবোধ চর্চা থেকে ক্রমেই দূরে সরছে। বরং রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় আইন ও শৃঙ্খলা বিচ্যুত অনেক দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটছে। এবং অনভিপ্রেত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে তার যথা প্রতিকার আশা করাই দুরূহ হয়ে পড়ছে। সে কারণেই র্যাগিং বন্ধে গত ১২ জানুয়ারি দেওয়া হাইকোর্টের একটি নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকারপক্ষের ঢিলেঢালা মনোভাবে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
র্যাগিং থেকে শিক্ষার্থীদের জীবন ও মর্যাদা রক্ষায় কার্যকর পদ্ধতি প্রবর্তনের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না, তা-ও জানতে চাওয়া হয়েছিল রুলে। স্বরাষ্ট্রসচিব, শিক্ষাসচিব, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানসহ বিবাদীদের চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হলেও তাঁরা তা দেননি। অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের তরফে রুলটির দ্রুত শুনানির ব্যাপারে উদ্যোগ থাকবে—তেমন প্রত্যাশা করা কঠিন। বরং শুনানি পিছিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে তাদের কোনো উদ্যোগ রয়েছে কি না, সেটই দেখার বিষয়। এমন পরিস্থিতিতে আমরা আশা করব যে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে র্যাগিং বন্ধে একটি উপযুক্ত নীতিমালা দেবেন। তবে সেই নীতিমালা অধিকতর কার্যকর হতে পারে, যদি জাতীয় সংসদ এগিয়ে আসে। আইনপ্রণেতাদের যা করণীয়, সেটা না করলে একটা শূন্যতা তৈরি হয়। সেই শূন্যতা সব সময় আদালতের তৈরি করা আইন দ্বারা সেভাবে পূরণ না-ও হতে পারে।
বুক ফুলিয়ে র্যাগিং করতে পারে তারাই, যাদের খুঁটির জোর এবং প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদ থাকে। যেকোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানই এ ধরনের প্রভাবের কাছে নমনীয় থাকতে বাধ্য হয়। তাই র্যাগিং বন্ধে সরকারকেই আইন করার উদ্যোগী হতে হবে। এটাই ভালো বার্তা দেবে। সে কারণে আমরা আশা করব, হাইকোর্টের নীতিমালার অপেক্ষায় না থেকে জাতীয় সংসদ অবিলম্বে আইন করবে। প্রচলিত আইনে নির্দিষ্টভাবে র্যাগিংবিরোধী কোনো বিধান নেই।