ওবায়দুল কাদেরের মাইলফলক ও ভোটারের 'অসহযোগ'
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ভোটের রাজনীতির প্রতি মানুষের অনীহা গণতন্ত্রের জন্য শুভ নয়। সিটি নির্বাচনের দিন তিনি অসুস্থ ছিলেন, হাসপাতালে ছিলেন। তারপর এটাই তাঁর প্রথম গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য। বাংলাদেশের রাজনীতি নির্বাচনমুখী। নির্বাচনই রাজনীতির আসল ঘটনা, তার জন্যই ৫ বছর সবকিছু করে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজধানীর স্থানীয় সরকার তো আর পুরোপুরি স্থানীয় না, বরং কেন্দ্রীয়। এ রকম কেন্দ্রীয় ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় দলের সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্য যেমন প্রত্যাশিত ছিল, তেমন তিনি বলেছেন।
একই কথা বেশির ভাগ পত্রিকার সম্পাদকীয় এবং টেলিভিশন টক শোগুলোতে বলা হয়েছে। বিএনপিরও এখানে দ্বিমত করার কিছু নেই। সুতরাং ওবায়দুল কাদেরের এই ভাষণ সত্য ভাষণ। বলা যায় তাঁর সঠিক বোধোদয় হয়েছে।
নির্বাচনই ছিল আওয়ামী লীগের রাজনীতির প্রাণরস, ভোটের প্রচারে জোয়ার আনার ক্ষমতা এই দলটির সবচেয়ে বেশি বলে দেখা গেছে। সেই দলের সাধারণ সম্পাদকের কথায় আক্ষেপের সুর, তাই ছোটখাটো ব্যাপার না। ঢাকা সিটি নির্বাচন নিয়ে তিনি বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের এত জনসমর্থন, সেখানে আরও বেশি ভোট আশা করেছিলাম। আওয়ামী লীগের যে ভোটের হার, সে তুলনায় উপস্থিতি আশানুরূপ নয়।’
অসুস্থ হয়ে কয়েক দিন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকার পর মঙ্গলবার সচিবালয়ে যান ওবায়দুল কাদের। সেখানে তিনি গত শনিবার অনুষ্ঠিত ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তখন এই কথাটা তিনি বলেন।
আওয়ামী লীগ গভীরভাবে নির্বাচনমুখী দল। ১৯৫৪ সাল থেকে বিরোধী দলে থেকে একের পর এক নির্বাচন দিয়ে বড় থেকে আরও বড় হয়েছে এই দল। বিরোধী দলে থেকে নির্বাচনে করার জন্য জনগণের বিভিন্ন অংশের সঙ্গে যোগাযোগ ও প্রভাব গড়তে এবং তা ধরে রাখা শিখতে হয়েছে। সেই কারণে আওয়ামী লীগের প্রচারযন্ত্রের প্রভাব ও আওয়াজ বেশি শোনা যায়। গত বেশ কয়েকটি নির্বাচনেও সেটাই দেখা গেছে। তাহলে এখন কেন ভিন্ন সুর? কেন এই আক্ষেপ?
তার মানে নির্বাচনমুখী সবচেয়ে প্রাচীন দলের দলীয় ঐতিহ্য আর কাজ করছে না। নাকি প্রচারকৌশলে ঘাটতি আছে? নাকি ক্ষমতায় থাকাজনিত দূরত্বের কারণে সেটার ধার ক্ষয়ে গেছে। ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা’ বলতে ওবায়দুল কাদের কি এই সমস্যার কথা মনে রেখেছেন?
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সাফল্য নির্বাচনী প্রতিযোগিতা ও আন্দোলনে। আন্দোলনে জয়ী হয়েই নির্বাচনে জয়ী হওয়া যায় বাংলাদেশে। কিন্তু ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থায় ভোটের রাজনীতি দিয়ে ক্ষমতা ধরে রাখা একটা সমস্যা। এর সমাধান অতীতে কেউ করতে পারেনি। নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতাসীন হওয়া কোনো সরকার বা দল পরপর দুবার ক্ষমতায় আসেনি। এটাও একটা দুর্বলতা। এই ‘সাংগঠনিক দুর্বলতা’র কোন সমাধান ওবায়দুল কাদের ভাবছেন?
এত দিন কথাটা অন্যরা বলতেন, এবার স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন। ঢাকার দুটি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে সরকারি হিসাবে ৭০ শতাংশ ভোটার ভোটে বিমুখ ছিলেন। বেসরকারি পর্যবেক্ষক থেকে শুরু করে গণমাধ্যমের যে সাক্ষ্য, তাতে ভোট পড়ার হার আরও অনেক কম। আগে বলা হতো জাতীয় নির্বাচনে রাজধানীতে যারা বেশি আসন পায়, সেই দলই সারা দেশে জয়ী হয়। রাজধানী ঢাকা একঅর্থে সারা দেশের সব শ্রেণির মানুষের আবাসিক উপনিবেশ। ছোট দেশের বড় রাজধানী হিসেবে ঢাকাই মোটামুটি বাংলাদেশ। সেই অর্থে ঢাকার কমপক্ষে ৭০ ভাগ ভোটারের ভোট ‘বর্জন’ জাতীয় জনমতেরই প্রতিচ্ছবি।
এই ছবিটা কারোরই পছন্দ হওয়ার কথা নয়। বিএনপি তাদের ভোটারদের ভোটকেন্দ্র পর্যন্ত আনতে পারেনি। তাদের এই না-পারার কারণটা খুবই স্পষ্ট। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় কেউ খেলতে পারে না। ভোটের দিন ভোটকেন্দ্রগুলোকে দলীয় দাপটের দুর্গ বানিয়ে রাখা হলে হাত-পা বাঁধা জনগণ ওদিকে পা বাড়াবে কীভাবে? ভোট দিতে যাবেন কীভাবে? দরজা বন্ধ রেখে, দরজার সামনে ভয়ের পাহারা বসিয়ে দেওয়া দাওয়াত কবুল করলেও যাওয়া যায় না। বিগত কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে অবাধে ভোট দিতে পারেনি মানুষ। যেহেতু ভোটারই আসেনি সেহেতু আওয়ামী লীগও দেখাতে পারেনি কতটা তাদের জনসমর্থন।
আর কোনভাবে নীরব জনগণ জানাতে পারত যে তারাও আছে? ভোটকেন্দ্রে তাদের জোরদার অনুপস্থিতি কি বর্তমান নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি, এই ব্যবস্থার সুফলভোগীদের প্রতি একধরনের অনাস্থা নয়? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবিত ও মৃত গল্পের কাদম্বিনী মরিয়াই প্রমাণ করিয়াছিল যে সে মরে নাই। তেমনি সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার ভোটকেন্দ্রে অনুপস্থিত থেকেও বুঝিয়েছেন তাঁরা কতটা উপস্থিত।
জনতার এই নীরব ‘অসহযোগ’ কিন্তু গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার জন্য শুভ। এর মর্মে থাকছে ওই কথাটা যে অবাধে ভোট দেওয়ার পরিবেশ না পেলে নামমাত্র নির্বাচন দিয়েই আইনি বৈধতার ‘পাস’ নিয়ে নিতে হবে। আর বিরোধীদেরও এর মাধ্যমে বলা হয়েছে, নির্বাচনের নিরপেক্ষ পরিবেশ নিশ্চিত না করে আমাদের কাছে ভোট চেয়ে সরকার বৈ আর কারও কোনো লাভ নেই।
এটা একটা স্পষ্ট বার্তা। কিন্তু জনগণের এই প্রত্যাখ্যানের ভাষাকেই ভোটের রাজনীতির প্রতি অনীহা হিসেবে পাঠ করেছেন অনেকে। ভোটের রাজনীতির প্রতি বাংলাদেশের মানুষের আসক্তি অতি প্রাচীন। দেশীয় প্রথম রাজা হিসেবে গোপাল একরকম নির্বাচিতই ছিলেন হাজার বছর আগে। পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক জাগরণের শুরুই হয়েছিল শেরেবাংলা ফজলুল হকের কৃষক প্রজা পার্টির ১৯৩৭ সালের নির্বাচনী জয় দিয়ে। সেটা ছিল এক সামাজিক বিপ্লব। আগে আন্দোলন হয়েছে, তারপর হয়েছে নির্বাচন। আন্দোলনে জয়ীরাই নির্বাচনে জয়ী হয়েছে প্রতিবার। আন্দোলন-নির্বাচন-পরিবর্তনের এই ট্রিপল গণতান্ত্রিক অ্যাকশন ১৯৪৬, ১৯৫৪, ১৯৭০, ১৯৯১-এ–ও সিরিজ আকারে ঘটেছে। ৭ মার্চের আগে ১৯৭০–এর নির্বাচন ছিল স্বাধীনতাসংগ্রামের শেষ শান্তিপূর্ণ জাতীয় অ্যাকশন। বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে নির্বাচনমুখী থাকার জ্বলন্ত বাস্তব কারণ ছাড়াও এসব ঐতিহাসিক কারণও খুব শক্তিশালী।
তা ছাড়া ভোটের রাজনীতির প্রতি অনীহা প্রমাণের জন্য তো আগে ভোটের রাজনীতিটা সামনে হাজির থাকতে হবে। সেটা নেই বলেই তো তার কদর বেশি। যা নেই তা না-করার দোষে জনগণকে দোষী করাটা অবিচার হয়ে যায়। অবাধে ভোট দেওয়ার সুযোগ থাকার পরও যদি ভোটাররা কম আসতেন, তাহলে বলা যেত যে ভোটে তাঁদের অরুচি হয়েছে। রাজনীতিতে অনাগ্রহ নয়, বরং চলমান রাজনীতি সম্পর্কে টনটনে জ্ঞানের প্রকাশই ঢাকাবাসী ভোটাররা দেখিয়েছেন।
এই ভোটারদের বড় অংশটাই তরুণ। যাঁদের বয়স এবার আঠারো হলো, তাঁরা বড় হয়েছেন ‘নিয়ন্ত্রিত’, ‘বিতর্কিত’, ‘রাতের ভোট’ ইত্যাদি দেখে দেখে। যেসব বিদ্যালয়ে ভোটকেন্দ্র বসানো হয়েছিল, সেসব বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও জেনেছে, নির্বাচনের দিন তাদের বিদ্যালয়ে কী হয়েছে এবং কী হয়। এই বিপুল ছাত্র-শিক্ষকের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনীহা হবে না কেন?
আর সাংগঠনিক দুর্বলতার কথাটা কিন্তু বিএনপি সম্পর্কে বলা হয় যে জনসমর্থন থাকলেও সাংগঠনিক দুর্বলতার কারণে দলটি ভুগছে। এখন ক্ষমতাসীন দলের অবস্থাও সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হলে দেশে সবল কে? কোনো দলের যদি জনসমর্থন বিপুল হয় আর ভোটকেন্দ্রগুলো যদি সেই দলের ব্যাজ পরা নেতা-কর্মীদের দ্বারা সুরক্ষিত থাকে, তাহলে সমর্থকেরা কেন ভোট দিতে যাবেন না? সাংগঠনিক দুর্বলতাই যদি হয় তাহলে তার সুযোগ বিএনপিই নিত সবার আগে।
এত নিয়ন্ত্রণের পরও, এত অল্পসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি সত্ত্বেও বিএনপির মেয়র প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের অর্ধেকের বেশি ভোট পেয়েছেন। অধিকাংশ কেন্দ্রে কোনো এজেন্টও যারা দিতে পারেনি, বুথের মধ্যে পাহারাদার থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রার্থীকে ভোট দিল কারা? ওবায়দুল কাদের সাহেবই একবার বলেছিলেন যে আওয়ামী লীগের ভেতরে অনেক ‘কাউয়া’ তথা ছদ্মবেশী বিএনপি ঢুকে পড়েছে। দলের নামে তারাই অপকর্মগুলো করছে। ক্যাসিনো-কাণ্ডেও অনুরূপ কথা শোনা গেছে। তাহলে কি আওয়ামী লীগের ভেতরে থাকা ঘাপটি মারা বিএনপির কর্মীরাই আওয়ামী লীগের ব্যাজ বুকে পরে ধানের শীষে ভোট দিয়ে গেছেন? অবরুদ্ধ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের ভোট কম পড়ার কারণ ব্যাখ্যা করা যায়, কিন্তু বিএনপির এত ভোট পাওয়ার ব্যাখ্যা এ ছাড়া আর কী? এটাই কি আওয়ামী লীগের সেই সাংগঠনিক দুর্বলতা ,যার কথা ওবায়দুল কাদের সাহেব বলেছেন।
সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এই দায় তো তাঁর ওপরও বর্তায়।
তবে কোনো দায় নেই নির্বাচন কমিশনের প্রধানের। সুষ্ঠু নির্বাচন করা এই নির্বাচন কমিশনের উদ্দেশ্য বলে কখনো মনে হয়নি। বরং নির্বাচন নামক অনুষ্ঠানে ভোটারদের দূরে রাখার নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কারই এঁদের কৃতিত্ব। এত বিতর্কের মধ্যেও অবাধে ইভিএমকে প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে এবারও তাঁরা সফল।
এর স্বীকৃতিও আলগোছে দিয়ে রেখেছেন ওবায়দুল কাদের সাহেব। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, দুই সিটিতে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) নতুন অভিজ্ঞতা। প্রায়োগিক বাস্তবতায় কিছু ভুলত্রুটি থাকতে পারে। যাঁরা ভোট দিয়েছেন, তাঁদের অনেকের প্রতিক্রিয়া—খুব সহজে ভোট দিতে পেরেছেন। এত বড় এলাকা নতুন যেহেতু, দু-একটি জায়গায় ভুলত্রুটি হয়েছে।
এদিক থেকে ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচন ভোটের রাজনীতিতে বিরাট পরিবর্তনের মাইলফলক।
ফারুক ওয়াসিফ: লেখক ও সাংবাদিক
[email protected]