করোনাভাইরাসের ঝুঁকি

মরণব্যাধি করোনাভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত মুক্ত রয়েছে, এটা স্বস্তির বিষয়। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলেছে, দেশে কেউ এতে আক্রান্ত বলে শনাক্ত হয়নি। তবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারিবিষয়ক উপদেষ্টা কমিটির একজন সদস্য নির্দিষ্টভাবে বলেছেন, বাংলাদেশ ঝুঁকিতে আছে।

এটা এমন এক পরিস্থিতি, যাতে আতঙ্কিত হওয়ার সুযোগ নেই, আবার অত্যন্ত সতর্ক থাকারও বিকল্প নেই। এই ভাইরাসে আক্রান্তদের যেহেতু এখন পর্যন্ত নির্দিষ্ট চিকিৎসা বা প্রতিষেধক নেই, তাই বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগজনকই থেকে যাবে। চীন থেকে সরকারি উদ্যোগে ফিরিয়ে আনা তিন শতাধিক বাংলাদেশিকে আশকোনায় হজ ক্যাম্পে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে এই ভাইরাসের সম্ভাব্য সংক্রমণ ও বিস্তার ঠেকাতে। তাদের মধ্যে সংক্রমণ নেই—নির্দিষ্ট সময় পর এটা নিশ্চিত হলে তা হবে বড় স্বস্তির বিষয়। কিন্তু বর্তমান বিশ্বে বিভিন্ন দেশের মধ্যে নানা মাত্রার যে সংযোগ ও নাগরিকদের আসা-যাওয়ার যে হার, তাতে এমন আরও অনেক পথ রয়েছে, যার ওপর ভর করে এই ভাইরাস দেশে ঢুকে পড়তে পারে। বাংলাদেশে ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটলে সম্ভাব্য স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনাটি কতটা দক্ষ ও কার্যকর হবে, সে বিষয়ে আমরা সংশয়মুক্ত হতে পারছি না। কারণ, সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধ ও চিকিৎসায় বাংলাদেশের সামর্থ্যে ঘাটতি রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এ ব্যাপারে একমত যে, শুধু করোনাভাইরাস নয়, যেকোনো সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা ও প্রস্তুতি সন্তোষজনক অবস্থা থেকে দূরে আছে। সুতরাং করোনাভাইরাস মোকাবিলা ও প্রতিরোধের বিষয়টিকে একটি সফল স্বাস্থ্য আন্দোলনে রূপ দেওয়ার কৌশল ও উপলক্ষ হিসেবে নেওয়া যেতে পারে।

নিপাহ, ইবোলা, সার্স, মার্সের মতো ভাইরাসের পর এখন করোনা এসেছে। কিন্তু এটাই যে শেষ নয়, সেই বিষয়টি আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তাই এ ধরনের সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের কার্যকর কৌশল হিসেবে সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসচেতনতা বাড়ানোর দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। পশুপাখি বা স্তন্যপায়ী প্রাণী যেহেতু করোনা বিস্তারের বড় উৎস, তাই বাংলাদেশ বড় ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। স্তন্যপায়ী প্রাণীর দ্বারা কোনো সংক্রমণ বা তা প্রতিরোধ করার বিষয়ে বাংলাদেশিদের গড়পড়তা সচেতনতার মান বেশ নিচে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে মাংস প্রক্রিয়াকরণ ও বিক্রি, প্রাণী সংরক্ষণে অব্যাহত ঢিলেঢালা মনোভাব, মানসম্মত কসাইখানা নির্মাণে সরকারি ও বেসরকারি খাতের ঔদাসীন্য নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। এ কারণে নতুন যেকোনো জীবাণু বিশ্বের যেখানে যখনই আঘাত হানবে, বাংলাদেশ একটি সফট টার্গেট হিসেবে বিবেচিত হবে। এ রকম একটি নাজুক অবস্থা থেকে স্থায়ীভাবে উত্তরণে বাংলাদেশের সংকল্পবদ্ধ হওয়া সময়ের দাবি।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় ইতিমধ্যেই উচ্চপর্যায়ের সরকারি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়েছে। তবে এই ভাইরাস শনাক্ত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য সংক্রান্ত কোনো তথ্য গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়নি। আমরা আশা করব, এ বিষয়ে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ একটি আশু ব্যাখ্যা দেবে। মহাখালীতে ছোট পরিসরের সংক্রামক ব্যাধি চিকিৎসার জন্য হাসপাতাল রয়েছে। এর বাইরে সংক্রামক রোগ সামাল দেওয়ার উপযুক্ত লোকবল ও অবকাঠামো–সংবলিত ব্যবস্থার ঘাটতি রয়েছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে কতগুলো বিষয়ে আশু পদক্ষেপ অপরিহার্য। হাঁচি, কাশি, মুখের লালা, নাক ও চোখের পানি এবং হাতের মাধ্যমে অন্যান্য সংক্রামক ব্যাধির মতো করোনাভাইরাস ছড়ায়। এই বিষয়গুলোর ব্যাপারে জনগণকে সচেতন করতে হবে এবং এই মুহূর্তে সচেতনতাকেই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে।

আমরা মনে করি, সরকার করোনাভাইরাস থেকে উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবিলায় জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সম্ভব সব রকম পদক্ষেপ নেবে। আর তারা সাধারণভাবে সংক্রামক ব্যাধি মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক সামর্থ্য বৃদ্ধিকল্পে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহণ করবে।