মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্র

ডান্স ক্লাবের আড়ালে গত দেড় বছরে সহস্রাধিক নারী পাচার হয়েছেন—র‌্যাবের দেওয়া এই তথ্য বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের ভয়াবহ চিত্রই তুলে ধরে। শুধু ডান্স ক্লাবের নামে যদি সহস্রাধিক নারী পাচার হয়ে থাকে, তাহলে বিদেশে লোভনীয় চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার নামে কত নারী-পুরুষ ও শিশু পাচার হতে পারে, তা অনুমান করা কঠিন নয়। একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর প্রায় ৭ লাখ মানুষ অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমান, যাঁদের একটি বড় অংশ যায় পাচার হয়ে।

র‌্যাবের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পাচারকারী চক্র নারায়ণগঞ্জে একটি নাচের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খুলে ট্রাভেল এজেন্সির মালিকের সঙ্গে যোগসাজশে সহস্রাধিক নারী পাচার করে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। গত নভেম্বরে এই চক্রের ছয়জন গ্রেপ্তার হওয়ার পর তাঁরা পাচারের কৌশল পাল্টে ফেলেন। আগে তাঁরা সরাসরি দুবাই ও মালয়েশিয়ায় নারীদের পাচার করতেন এবং এখন সেটি না করে আরও কয়েকটি দেশকে ট্রানজিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করেন।

র‌্যাব বা পুলিশের অভিযানে যেসব নারী উদ্ধার হয়েছেন, তাঁদের ভাগ্যবান বলতে হবে। তাঁরা নিজের ঠিকানায় ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু যাঁরা পাচারকারীদের খপ্পরে পড়ে ইতিমধ্যে দেশের বাইরে চলে গেছেন, তাঁরা দুর্বিষহ জীবন যাপন করছেন। চাকরি দেওয়ার নাম করে নেওয়া হলেও তাঁদের যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার কমবেশি সব সময়ই ছিল। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা আশ্রয় নেওয়ার পর সেই পাচারের মাত্রা আরও বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী, নিরাপত্তা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা উৎকোচের বিনিময়ে পাচারকারীদের সহায়তা করে থাকেন। অন্যদিকে মানব পাচারকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার নজির খুবই কম। অনেকে ধরা পড়েন না, যাঁরা ধরা পড়েন, তাঁরাও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে বেরিয়ে আসেন। মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মন্তব্য করেছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। 

মানব পাচারের পেছনে দারিদ্র্য, কর্ম সুযোগের অভাব, স্বল্প শিক্ষা, ভঙ্গুর পরিবার, পরিবেশ ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অভিবাসন নীতিমালা ইত্যাদিকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রভূত উন্নতি করার পরও বেকারত্ব বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছর আমাদের শ্রমবাজারে যে ২২–২৩ লাখ তরুণ প্রবেশ করেন, তার সামান্য অংশই  কাজ পাচ্ছেন। বাকিরা বেকারত্বের অভিশাপ বয়ে বেড়াচ্ছেন। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে পাচারকারী চক্র নানা প্রলোভন দেখিয়ে বেকার তরুণ-তরুণীদের বিদেশে পাচার করছে। আমাদের জনসংখ্যার একাংশ এখনো শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। ফলে নানা প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পাচার করা সহজ হয়।

বাংলাদেশ থেকে মানব পাচারের এই ভয়ংকর প্রবণতা বন্ধ করতে হলে রাষ্ট্রকে আরও কার্যকর ও টেকসই পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রথমত দেশের ভেতরেই কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে, যাতে পাচারকারী চক্র বেকারদের প্রলুব্ধ করার সুযোগ না পায়। এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রবৃদ্ধিমুখী উন্নয়নকে কর্মসংস্থানমুখী করতে হবে। তবে মানব পাচার রোধে সবচেয়ে জরুরি যে কাজ সেটি হলো পাচারকারীদের দ্রুত বিচারের মুখোমুখি করা। যাঁরা মানব পাচারে সহায়তা করবেন, তাঁদেরও আইনের আওতায় আনতে হবে।

মানব পাচার একটি গুরুতর অপরাধ। এর সঙ্গে রাষ্ট্রের মানমর্যাদার প্রশ্নও আছে। পাচারের শিকার মানুষগুলো যেমন দুর্বিষহ জীবন যাপন করছে, তেমনি দেশে তাদের স্বজনদের জন্যও নিয়ে আসছে বেদনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তা। উন্নয়নের সড়কে দ্রুত ধাবমান বাংলাদেশকে কোনোভাবেই মানব পাচারের উৎসভূমি হতে দেওয়া যায় না।