জাতিসংঘ মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের এক ধাপ এগোনো নিশ্চয়ই ইতিবাচক ঘটনা, কিন্তু সার্বিক বিচারে বাংলাদেশের অবস্থানকে আশাপ্রদ বলা যায় না কোনোভাবে। ২০১৯ সালের জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫তম। ২০১৮ সালের বিভিন্ন দেশের স্বাস্থ্য, শিক্ষা, গড় আয়সহ বিভিন্ন সূচকের আলোকে এই প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে।
গত বুধবার ঢাকায় পরিকল্পনা কমিশনে ইউএনডিপির এই প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ইউএনডিপি ঢাকা কার্যালয়ের কর্মকর্তা শামসুর রহমান প্রতিবেদনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন।
মানব উন্নয়ন সূচকে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে থাকলেও দক্ষিণ এশিয়ায় পঞ্চম অবস্থানে আছে। বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপ। পিছিয়ে আছে পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও নেপাল।
গতবারের মতো এবারও জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকের শীর্ষ আছে নরওয়ে। আমরা এখনই হয়তো ইউরোপের নরওয়ে কিংবা এশিয়ার সিঙ্গাপুরের সমকক্ষ হওয়ার চিন্তা করতে পারি না, কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে থাকা অসম্ভব নয়। ইউএনডিপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ গড় আয়ু, নারীর ক্ষমতায়ন, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণে এগিয়ে আছে, কিন্তু মাথাপিছু গড় আয়ে ওই দুটি দেশ থেকে পিছিয়ে আছে। ক্রয়ক্ষমতার সক্ষমতা অনুসারে বাংলাদেশের মানুষের গড় আয় যেখানে ৪ হাজার ৫৭ ডলার, সেখানে ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ৬ হাজার ৮২৯ ও ৫ হাজার ১৯০।
সে ক্ষেত্রে আমাদের সম্পদ বাড়ানোর দিকে অধিক মনোযোগী হতে হবে। আর সম্পদ তখনই বাড়বে, যখন শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে প্রচুর বিনিয়োগ করা হবে। এই দুটি খাতে আগের চেয়ে বরাদ্দ বাড়লেও এখনো অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় কম আছে। বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তান তিনটি দেশেই ধনবৈষম্য প্রকট। বাংলাদেশে ১০ শতাংশ ধনীর কাছে মোট সম্পদের ২৬ দশমিক ৮ শতাংশ আছে, আর ভারত ও পাকিস্তানে যথাক্রমে ৩০ ও ২৯ শতাংশ। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছুটা এগিয়ে থাকলেও উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ১০ শতাংশ মানুষের কাছে যদি ২৬–২৭ শতাংশ সম্পদ থাকে, তাহলে যতই উন্নয়ন হোক না কেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বঞ্চিতই হতে থাকবে। হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যেসব সহায়ক কর্মসূচি আছে, সেগুলো ঠিকমতো ব্যয় হয় না, সে কথা পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নানের কথায়ও উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, ‘সরকারের প্রণোদনার ভর্তুকি প্রকৃত লোকের কাছে না পৌঁছানোয় বৈষম্য বাড়ছে। এটি এক সমস্যা। আমাদের মূল লক্ষ্য দেশজ উপায়ে উন্নয়ন।’ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমানও শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতার কথা উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে, বিভিন্ন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থার কারণে বৈষম্য বাড়ছে।
আমাদের শিক্ষা উপযোগিতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি বিআইডিএসের এক জরিপে দেখা গেছে, উচ্চশিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এক-তৃতীয়াংশ বেকার থাকছে। কোনো কাজ পাচ্ছে না। অর্থাৎ, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা দক্ষ ও যোগ্য জনশক্তি তৈরি করতে পারছে না। এ অবস্থায় মানবসম্পদের কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন আশা করা যায় না।
সে ক্ষেত্রে সরকারের উন্নয়ন কৌশল বদলাতে হবে। যেই উন্নয়ন ধনীকে আরও ধনী করে এবং গরিবের অবস্থান আরও দুর্বল করে, সেই উন্নয়ন প্রত্যাশিত নয়। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারের গৃহীত সব সরকারি কর্মসূচির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দরিদ্র মানুষের হক নিয়ে কেউ নয়ছয় করে পার না পায়। একই সঙ্গে শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে প্রত্যেক শিক্ষিত মানুষ কাজ পায়। উন্নয়নের রোল মডেলের দাবিদার দেশে এক-তৃতীয়াংশ বেকারের শিক্ষা কোনোভাবেই কাম্য হতে পারে না।