বর্তমান সরকার রেলের ‘অবকাঠামোগত’ উন্নয়নে শুরু থেকেই যথেষ্ট অর্থ ঢেলেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও রেল কেন অব্যাহতভাবে লোকসানের মুখ দেখছে এবং যাত্রীসেবার মান কেন এখনো তলানিতে রয়েছে, সেটা নীতিনির্ধারকদের নির্মোহভাবে খতিয়ে দেখা দরকার। এখন রেলের সেবা সপ্তাহ চলছে। ৪ ডিসেম্বর শুরুর দিনে কোনো কোনো ট্রেনে রেল কর্তৃপক্ষের তরফে যাত্রীদের ফুল দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে। রেলের যাত্রীসেবার মান যতটা নিচে নেমেছে, সেখানে এই ফুলসেবা গভীর ক্ষতে আদৌ কোনো প্রলেপ দিতে পারবে কি?
নতুন নতুন বৃহৎ প্রকল্প নেওয়া এবং তাতে টাকা ঢালা অপেক্ষাকৃত সহজ। বাংলাদেশের সরকারগুলো যখন অর্থাভাবে বিনিয়োগ করতে পারেনি, তখন অনেকের ধারণা ছিল, টাকা এলে সুদিন আসবে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ প্রমাণ করছে, টাকাই বড় প্রতিবন্ধক নয়। অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দশার উন্নতি করা সম্ভব না হলে বড় বিনিয়োগের গল্প শুনিয়ে লাভ হবে না। এমনকি বিনিয়োগ করতে গিয়েও কিছু অপ্রিয় সত্য প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু তা থেকে কারও শিক্ষা নেওয়ার কোনো গরজ নেই। দক্ষ জনবল ও রেল নামের প্রতিষ্ঠানটির সামর্থ্য না থাকলে সেই ঘাটতি বিনিয়োগ পূরণ করতে পারে না।
রেলের অবকাঠামোগত উন্নয়নে টাকা ঢালার আগে উচিত ছিল সুষ্ঠু পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে সামর্থ্য বাড়াতে সচেষ্ট হওয়া। রেলে যখন স্বল্প অর্থের বিনিয়োগ ছিল, তখনো লোকসান, অপচয় ও ব্যবস্থাপনাগত দীনতা ছিল, এখনো আছে। অদক্ষতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো, বিনিয়োগের অর্থ রেল খরচ করতে পারে না। গত পাঁচটি অর্থবছরে বিভিন্ন উন্নয়ন ও কারিগরি প্রকল্পে ৫০ হাজার কোটি টাকার বেশি তহবিল বরাদ্দ করা হলেও রেল বাস্তবে খরচ করতে পেরেছে অর্ধেকের সামান্য বেশি। রেল যদি তার এই সামর্থ্যহীনতা ঘোচানোর চেষ্টা না করে, তাহলে এই করুণ দৃশ্যপট রাতারাতি বদলাবে না।
উপরন্তু রেল কর্তৃপক্ষ যেভাবে খরচ করে চলেছে, তার যথার্থতার প্রশ্ন তো কম জ্বলন্ত নয়। সড়ক, আকাশ ও নৌপথে বেসরকারি পরিবহন খাতে বিপুল বিনিয়োগের কারণে যাত্রীসেবার মান বেড়েছে। এবং এই খাতগুলো লাভজনক। কিন্তু রেল যখন ৩৬ প্রকল্পে সোয়া লাখ কোটি টাকার বেশি খরচ করছে, তখনো এটি লোকসানে ধুঁকছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১ হাজার ৪৩২ কোটি টাকার লোকসান, পরের অর্থবছরে আরও ৩০০ কোটি টাকা বেড়ে ১ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। অতঃপর অহরহ রেল দুর্ঘটনা, অপরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশে ভ্রমণ এবং সময়সূচি বিপর্যয় তো রেলের পিছু ছাড়ছে না।
লোকসানের বিষয়ে রেলের মহাপরিচালক মো. শামসুজ্জামান দাবি করেছেন, রেল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বাণিজ্যিক সংস্থা নয়। তাঁর এই যুক্তি একটা আপাতগ্রাহ্য হলেও চূড়ান্ত বিচারে তা ভিত্তিহীন। রুগ্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলো যুগে যুগে এ দেশে এমনই এক অভিন্ন সাফাই বক্তব্য দিয়ে চলেছে। আকাশ ও নৌপথে কমবেশি সরকারি যানগুলোকে বেসরকারি শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু রেল হলো একচেটিয়া। যানজট, ভাঙাচোরা সড়কে বেহাল সড়কব্যবস্থায় বাংলাদেশের রেল একটি সবচেয়ে লাভজনক সংস্থায় পরিণত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার রুগ্ণ দশা কিছুতেই কাটছে না। সরকারকে অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দেওয়ার একচোখা নীতি বদলাতে হবে। সুষ্ঠু রক্ষণাবেক্ষণ, দক্ষ জনশক্তি তৈরি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ওপরই রেলকে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। উন্নয়ন তো লাগবেই। কিন্তু তা সামর্থ্য ও যাত্রীসেবার মান বাড়িয়ে রেলকে একটি অধিকতর নিরাপদ বাহনে পরিণত করার নীতি জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।