না বলতে পারা গণমাধ্যমের বিকাশ
বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমের বর্তমান ছবিটি কেমন তার উত্তর দুভাবে দেওয়া যায়। একটি হচ্ছে এমন বিকাশ অভূতপূর্ব। যেন মাও সে তুংয়ের ‘শত ফুল ফুটতে দাও’ তত্ত্বটি এখানে নিষ্ঠার সঙ্গে অনুসরণ করা হয়েছে। কয়েক ডজন টেলিভিশন চ্যানেল, ডজনখানেকের বেশি এফএম রেডিও, কয়েক শ জাতীয় দৈনিক, হাজারের ওপর আঞ্চলিক পত্রিকা এবং অসংখ্য অনলাইন পোর্টাল। এই উত্তর সরকার এবং ক্ষমতাসীন দল বা জোটের নেতারা প্রচার করে বোঝাতে চান, এই সংখ্যাধিক্যই হচ্ছে সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতার প্রমাণ। একই কথার বহুল পুনরাবৃত্তির মাধ্যমে মানুষকে সংবাদমাধ্যম থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে এটি কতটা কার্যকর, তা বেশ ভালোভাবেই অনুভূত হচ্ছে।
গণমাধ্যমের হালচাল সম্পর্কে দ্বিতীয় জবাবটি হচ্ছে এটি গভীর সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে। এই বক্তব্য মূলত গণমাধ্যমের ভেতরের লোকেরাই সবচেয়ে বেশি বলে থাকেন। সংকটের কথা শুধু সংবাদ–সম্পর্কিত নয়, বিনোদন এবং শিল্পমাধ্যম হিসেবে যেসব প্রতিষ্ঠান চালু আছে, তাদেরও কথা। সম্পাদকেরা বলছেন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হুমকির মুখে; যে কথা লিখতে চাই তা লিখতে পারি না। সংবাদপত্র প্রকাশকেরা বলছেন, সরকারের কর নীতি, আমদানি শুল্ক, বিজ্ঞাপনে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ এবং ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের বোঝা শিল্পটিকে অস্তিত্বের সংকটে ঠেলে দিয়েছে। টিভি চ্যানেলের মালিকেরা চাইছেন বিজ্ঞাপনের সীমিত বাজারের সুরক্ষা। বাংলাদেশি পণ্যের বিজ্ঞাপন বিদেশি চ্যানেল ও অনলাইনে চলে যাওয়ায় তাঁদের আয় ক্রমে কমছে এবং তাঁরা এখন ব্যয় সংকোচনের পথ বেছে নিয়েছেন। অনলাইন পোর্টালগুলোর অভিযোগ, সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলো যেসব সরকারি বিজ্ঞাপন পায়, তারা তার কিছুই পায় না।
গণমাধ্যমের এই সংকট বহুমাত্রিক। সংবাদপত্র ও টিভি-রেডিওর সমস্যা যেমন এক নয়, তেমনি সংবাদভিত্তিক টিভি-রেডিও এবং বিনোদনপ্রধান চ্যানেলের সমস্যাও এক নয়। আবার অনলাইন পোর্টাল বলে আগে যেগুলোকে মূলধারার গণমাধ্যম হিসেবে বিবেচনা করা হতো না, তাদের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমগুলোর অনলাইন সংস্করণের বিকাশ। এগুলোর পাশাপাশি নতুন চ্যালেঞ্জ হিসেবে যা আবির্ভূত হয়েছে তা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম, যেখানে যাচাই-বাছাই ও সম্পাদনা ছাড়াই তথ্য ও মতামতের তাৎক্ষণিক আদান-প্রদান ঘটছে।
গণমাধ্যমের এসব বহুমাত্রিক সংকটের মধ্যে তিনটি অভিন্ন উপাদান লক্ষণীয়। প্রথমত: মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সংকোচন যা আনকোরা সত্য প্রকাশে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং সংবাদমাধ্যমের বিশ্বাসযোগ্যতা ও সাংবাদিকতা পেশার মর্যাদাকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। দ্বিতীয়ত: দক্ষ কর্মশক্তির অভাব। এর পরিণতিতে গুণগত মানসম্পন্ন প্রতিবেদন, বিতর্ক-আলোচনা, প্রামাণ্যচিত্র, তথ্যসমৃদ্ধ অনুষ্ঠান তৈরি হচ্ছে না। গণমাধ্যমকে সৃজনশীল শিল্প (ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রি) হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা কার্যত একেবারেই অনুপস্থিত। তৃতীয়ত: পর্যাপ্ত ও প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের অভাব। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পত্রিকা-টিভি-রেডিও-অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বিভিন্ন বাণিজ্যিক গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থসিদ্ধির মাধ্যম হিসেবে।
ফলে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষায় সোচ্চার হয়ে নিজেদের বিশ্বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধারের চেষ্টার বদলে এই শিল্পে সরকারের তুষ্টি সাধনে মনোযোগ বেশি। এরা তাই বিজ্ঞাপনের বাজারকে রক্ষার দাবিতে এবং বিদেশি সৃজনশীল পণ্য (ধারাবাহিক নাটক, টেলিছবি, তথ্যচিত্র প্রভৃতি) আমদানির বিরুদ্ধে সোচ্চার। বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান তার পণ্য বিদেশে বিপণন করলে বাণিজ্যিক বিবেচনায় বিদেশে বিজ্ঞাপন দেবে, সেটাই স্বাভাবিক। অথচ এ রকম পদক্ষেপকেই তারা টিকে থাকার একমাত্র উপায় বলে ভাবছে। সৃজনশীল অনুষ্ঠান নির্মাণে বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেশি চ্যানেলের প্রতি মানুষের মনোযোগ ফিরিয়ে আনার চেষ্টার বদলে তারা ভাবছে বিদেশি অনুষ্ঠানের রূপান্তর বন্ধ করা হলে দর্শক তাদের কাছে ফিরে আসতে বাধ্য হবে। টক শো ও নাটকে সব চ্যানেলে একই মুখগুলোর বৈচিত্র্যহীন উপস্থিতিতে ত্যক্ত-বিরক্ত দর্শকেরা যে অনলাইনে নেটফ্লিক্স বা আমাজনের স্ট্রিমিং সার্ভিসে বিনোদন খুঁজছেন, তা যদি এখনো তাঁরা উপলব্ধি না করেন, তাহলে তাঁদের দুর্ভোগ যে আরও প্রসারিত হবে, সেটা বলাই বাহুল্য। দেশি ট্যাক্সি-সিএনজি ব্যবসায়ীদের দাপট রাতারাতি চূর্ণ করে দেওয়া উবার-পাঠাও-ওভাইয়ের মতো প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকেও কিন্তু আমাদের শেখার আছে।
আগেই বলেছি, গণমাধ্যমের সংকট বহুমাত্রিক এবং সংবাদমাধ্যমের চ্যালেঞ্জগুলো অন্যান্য মাধ্যমের মতো নয়। সংবাদমাধ্যমের কাছে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা অনেক বেশি এবং এর দায়িত্বের ব্যাপ্তিও অনেক বিস্তৃত। সংবাদমাধ্যম এই দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে কেবল তখনই, যখন নির্ভয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা থাকে। মতপ্রকাশের পর স্বাধীনতা হারিয়ে কারাগারে ঠাঁই হলে কিংবা জেলায় জেলায় মামলা, হুমকি আর হয়রানির শিকার হতে হলে স্বাধীন সাংবাদিকতা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাই মুক্ত সাংবাদিকতার আবশ্যিক শর্ত গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে তাই সংবাদমাধ্যমেরও উদ্যোগী ও সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন। প্রশ্ন হচ্ছে দলীয় আনুগত্য ও বিভাজনের রাজনীতি এবং ব্যক্তিস্বার্থের বন্ধন থেকে বেরিয়ে এসে সে রকম ভূমিকা কারা কতটুকু নিতে পারবেন।
২ নভেম্বর ছিল সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অপরাধের বিচারহীনতার অবসান দিবস। আমরা এখানে স্মরণ করতে পারি যে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত প্রতিবেদনের জন্য আদালতের কাছ থেকে এ পর্যন্ত ৯০ বারের বেশি সময় চাওয়া হয়েছে। সাগর-রুনির আগে এবং পরে আরও যে সাংবাদিকেরা নিহত হয়েছেন (যেমন শামসুর রহমান এবং আবদুল হাকিম শিমুল), তাঁদের হত্যার বিচারও সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় নেই।
এত সমস্যার মধ্যেও আশার কথা হচ্ছে সংবাদমাধ্যমগুলোর মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান মানসম্পন্ন সাংবাদিকতায় মনোযোগী হয়েছে, তারা সব প্রতিকূলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। ২৪ ঘণ্টার টিভির সরাসরি সম্প্রচার এবং ব্রেকিং নিউজ মানুষের তথ্যচাহিদা পূরণে অক্ষম বলে প্রমাণিত হয়েছে। মানুষ ঘটনার পেছনের ঘটনা, সামগ্রিকতা ও এরপর কী অথবা যা ঘটেছে তাতে আমার কী—এসব প্রশ্নের উত্তর চায়। সোশ্যাল মিডিয়ার অসম্পাদিত তথ্যের সত্যাসত্য যাচাই করতে চায়। ক্ষমতাবানেরা যা বলছেন তার কতটা ঠিক আর কতটা বেঠিক, তা জানতে চায় এবং তাঁদের জবাবদিহির কাঠগড়ায় দেখতে চায়। সাংবাদিকতা ও সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব তাই একটুও কমেনি, বরং বেড়েছে। তবে সংবাদপত্রগুলোও এখন আর শুধু পত্রে না থেকে বহুমাত্রিক মাধ্যমে রূপান্তরিত হচ্ছে। একই সঙ্গে তার প্রচার পরিধি বিস্তৃত হচ্ছে বিশ্বের সব প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা নির্দিষ্ট ভাষাগোষ্ঠীর পাঠকের কাছে।
প্রচলিত ধারার সংবাদমাধ্যমের কাজের ক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়ার চ্যালেঞ্জকেও আর খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। ফেসবুক ও টুইটারের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বুঝতে পেরে গুজব বা ভুয়া খবর বন্ধ করতে পেশাদার সাংবাদিক নিয়োগ করে তথ্যপ্রবাহ সম্পাদনার দিকটিতে মনোযোগী হয়েছে। ধর্মবিদ্বেষ, বর্ণবাদী ঘৃণা, উসকানিমূলক বক্তব্য ও প্রচারসামগ্রী দ্রুততম সময়ে অপসারণে তারা তৎপর হয়েছে। সরকারগুলোও এ ক্ষেত্রে সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করছে। ভিন্নমত ও সমালোচনাকে রাষ্ট্রবিরোধী, উসকানিমূলক বা শান্তি বিনষ্ট করার চেষ্টা হিসেবে অভিহিত করে সেগুলো অপসারণে সোশ্যাল মিডিয়া কোম্পানিগুলোর ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে। ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের বিষয়ে ইসরায়েলি সরকার এবং কাশ্মীরের প্রশ্নে ভারত সরকার এ ক্ষেত্রে অনেকটাই সফল হয়েছে। বাংলাদেশেও টেলিযোগাযোগমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ের বক্তব্যে এ ধরনের আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ লক্ষণীয়।
রাজনীতিকেরা মেঠো বক্তৃতায় অনেক কিছুই বলেন, যেগুলো তাঁরাও জানেন সঠিক নয় কিংবা বাস্তবে সম্ভব নয়। তাঁরা আশা করেন তাঁদের সেসব কথা সাংবাদিকেরা অবিকল পত্রিকার পাতায় ছাপাবেন, রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করবেন। রাজনীতিকদের বক্তব্য ও অঙ্গীকারের গুরুত্ব শুধু তাঁদের অনুসারীদের মধ্যেই সীমিত থাকে না, তার প্রভাব অনেক বিস্তৃত। সুতরাং তাঁদের বক্তব্যে ভুল থাকলে, তা বিভ্রান্তিকর হলে সেগুলো চিহ্নিত করা সাংবাদিকতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত ও দায়িত্ব।
যুক্তরাষ্ট্রের পত্রিকা ওয়াশিংটন টাইমস তাই বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অসত্য বক্তব্যগুলো নিয়মিত আলাদা করে তুলে ধরছে এবং তার হিসাবটা পাঠকদের জানিয়ে দিচ্ছে। তাদের হিসাবে গত ১৪ অক্টোবর পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তাঁর প্রথম ১ হাজার দিনে মোট ১৩ হাজার ৪০০ বার অসত্য বা বিভ্রান্তিকর কথা বলেছেন। সাংবাদিকতায় এমন দায়িত্বশীলতা আমাদের দেশে আদৌ কোনো দিন অর্জন সম্ভব নয় বলে অনেকেরই আশঙ্কা। আমাদের চ্যালেঞ্জটা সেখানেই। সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলার সাহস ও সততা অর্জনের আশাবাদটা জিইয়ে থাকুক।
কামাল আহমেদ: সাংবাদিক