বিজ্ঞানী রোনাল্ড রস শেষ বয়সে দুঃখ করে বলেছিলেন, ম্যালেরিয়া-সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তাঁকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে, তাঁর নামে গবেষণা প্রতিষ্ঠান বানানো হয়েছে, সম্মানের অন্ত নেই, শুধু মশা খেদানোর জন্য তিনি যা যা করতে বলেছিলেন, তার কিছুই করা হয়নি। মশকনিধনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কর্তৃপক্ষ এবং সাধারণ নগরবাসীর উদাসীনতা রোনাল্ড রসের সেই আক্ষেপ মনে করিয়ে দিচ্ছে।
কোনো কোনো পরীক্ষায় ‘নেগেটিভ’ নম্বর দেওয়ার প্রচলন আছে। সেই নিয়ম মানলে মশার প্রকোপ ও ডেঙ্গু জ্বর মোকাবিলায় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের প্রাপ্য নম্বর অন্তত মাইনাস ৩। মশকনিধন, রোগ প্রতিরোধ এবং জরুরি ভিত্তিতে সংকটের মোকাবিলা—এই তিন নিরিখেই নগর কর্তৃপক্ষের প্রাপ্য নম্বর শূন্য থেকেও কম। কারণ, ডেঙ্গুতে মানুষের মৃত্যু বন্ধ তো হয়ইনি, উপরন্তু এখন গোদ রোগের আশঙ্কা মাথাচাড়া দিচ্ছে। এক দুশ্চিন্তা শেষ না হতেই আরেক দুশ্চিন্তা নগরবাসীর মনে ভর করা শুরু করেছে।
গত জুলাই, আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত রাজধানীতে ডেঙ্গু যে চেহারা নিয়ে ‘আবির্ভূত’ হয়েছিল, তাতে অনেকেই তখন মহামারির আশঙ্কা করেছিলেন। সেই আশঙ্কা অমূলক ছিল না। দুই নগরেরই কর্তৃপক্ষ তখন চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। অনেক মানুষ ডেঙ্গুতে মারা গেছে। এখনো এক দিন–দুই দিন পরপর রাজধানী ও বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। মশকনিধনে সিটি করপোরেশন যে ওষুধ ব্যবহার করছিল, তা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছিল। পরে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে কর্তৃপক্ষ তাড়াহুড়া করে নতুন ওষুধ এনে মশকনিধন কার্যক্রম জোরেশোরে শুরু করে। কিন্তু সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ থেকে মশা মারার কার্যক্রমে ঢিলেঢালা ভাব দেখা দিয়েছে। এই সুযোগে মশার উপদ্রব বেড়েছে।
প্রথম আলোর প্রতিবেদন বলছে, রাজধানীবাসী এখন মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ। গত ১৫ দিনে মশার ওষুধ ছিটানো সাধারণের চোখে পড়েনি। ওয়ার্ডে পরিচ্ছন্নতাকর্মী যাঁরা আছেন, তাঁরা নিয়মিত নালা পরিষ্কার করছেন না। নালাগুলো মশার আঁতুড়ঘর হয়ে উঠেছে। কীটতত্ত্ববিদদের বক্তব্য হলো, ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী এডিসের উপদ্রব কমে এসেছে, কিন্তু কিউলেক্স মশার উপদ্রব বেড়েছে। স্ত্রী কিউলেক্স মশার মাধ্যমে অসুস্থ ব্যক্তির শরীর থেকে সুস্থ ব্যক্তির শরীরে ফাইলেরিয়া সংক্রমণ হতে পারে। ‘গোদ’ নামে পরিচিত এই রোগের কারণে হাত-পা ফুলে যায়। বারবার জ্বর হয়। এতে রোগী মারাও যেতে পারে। এ অবস্থায় নতুন করে দুর্যোগ এড়াতে হলে মশকনিধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। মশা মারার ওষুধ মাঝেমধ্যে ছিটালে চলবে না, নিয়মিতভাবে ছিটাতে হবে, যেন মশা বংশবিস্তারের সুযোগ না পায়। এ ব্যাপারে কোনো ধরনের অবহেলা গ্রহণযোগ্য নয়। নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনার পাশাপাশি জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগও নেওয়া প্রয়োজন। আর ডেঙ্গু বা গোদ—যে রোগেই মানুষ আক্রান্ত হোক না কেন, সুচিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে, যেন কারও মৃত্যু না ঘটে।
আশার কথা, কিউলেক্স মশার উপদ্রব সম্পর্কে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা গত ২৮ অক্টোবর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন। সেই অভিযান অর্থবহ করাটাই এখন মূল লক্ষ্য বলে ধরে নিতে হবে। যেহেতু শীতকালে কিউলেক্স মশার প্রকোপ বাড়ে, সেহেতু পুরোপুরি শীত পড়ার আগেই যেকোনো মূল্যে এই মশাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।
কর্তৃপক্ষ ও নগরবাসীকে বুঝতে হবে মশকনিধন, মশার জন্ম ও বংশবৃদ্ধি নিরোধ, মশার কামড় থেকে বাঁচা—এর কোনোটির জন্যই দুর্মূল্য প্রযুক্তির প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন জনসচেতনতা। সেটি সবার মধ্যে থাকলে ডেঙ্গুর ওষুধ ও চিকিৎসক বাবদ যা খরচ হবে, তার সামান্য ভগ্নাংশ খরচ করে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এই সত্য সর্বাঙ্গীণভাবে উপলব্ধির সময় এসেছে।