যেকোনো শিক্ষার্থীর জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভাবা হয়। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষার্থীরা উপযুক্ত শিক্ষা পেলে উচ্চশিক্ষার ভিতও সুদৃঢ় হবে। কিন্তু মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের নিয়ে ‘সেকেন্ডারি স্কুল টিচার্স ইন বাংলাদেশ: ইন দ্য লাইট অব এসডিজি ফোর’ শীর্ষক জরিপে যেসব ফলাফল এসেছে, তা খুবই উদ্বেগজনক।
গণসাক্ষরতা অভিযান পরিচালিত জরিপের বিষয় ছিল মাধ্যমিক শিক্ষকদের শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ, আয় ও কর্মসন্তুষ্টি, কর্মভার ও শ্রেণি কার্যক্রম তত্ত্বাবধান, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষণ-শিখন, মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার, প্রাইভেট টিউশন ও গাইড বইয়ের ব্যবহার। জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ইংরেজি, বিজ্ঞানসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধিকাংশ শিক্ষকের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ নেই। জীববিজ্ঞানের ৭০ শতাংশ, পদার্থবিজ্ঞানের ৭৫ দশমিক ৫ ও রসায়নের ৭৭ দশমিক ৫ শতাংশ শিক্ষক বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ পাননি। এ ছাড়া বাংলার ৬৭ শতাংশ, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ৭৮, সাধারণ বিজ্ঞানের ৬৪ ও হিসাববিজ্ঞানের ৬৬ শতাংশ শিক্ষকও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন। মাধ্যমিকের ৩৪ শতাংশ শিক্ষকের বিএড, এমএড ও বিপিএডের মতো পেশাগত প্রশিক্ষণও নেই বলে উল্লেখ করা হয় ওই প্রতিবেদনে।
কোনো ব্যক্তির উচ্চশিক্ষার ডিগ্রি থাকলেই তিনি দক্ষ শিক্ষক হতে পারেন না। দক্ষ শিক্ষক হতে হলে শিক্ষাদানের বিষয়েও প্রশিক্ষণ থাকা প্রয়োজন। প্রশিক্ষণ না থাকার কারণে বেশির ভাগ মাধ্যমিক শিক্ষক আত্মবিশ্বাসহীনতায় ভুগছেন। জরিপমতে, নিজেকে উচ্চপর্যায়ের দক্ষ মনে করেন শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ শিক্ষক, দক্ষ মনে করেন ১৫ শতাংশ শিক্ষক। এ ছাড়া ৩৯ দশমিক ৮ শতাংশ নিজেদের পরিমিত দক্ষ, ২৭ দশমিক ৬ শতাংশ গড়পড়তা দক্ষ ও ১৩ দশমিক ৭ শতাংশ শিক্ষক সীমিত পরিমাণে দক্ষ মনে করেন। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ থাকলে সব শিক্ষকেরই নিজেকে দক্ষ ভাবার কথা।
সম্প্রতি সরকার ডিজিটাল শিক্ষার নামে অনেক বিদ্যালয়ে মাল্টিমিডিয়া পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও ফলাফল হতাশাজনক। মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার বিষয়ে অনেক শিক্ষকের প্রশিক্ষণ নেই। এ ছাড়া বিদ্যুৎ-বিভ্রাট, শ্রেণিকক্ষের অপ্রতুলতা, পর্যাপ্ত সরঞ্জামের অভাব, ত্রুটিপূর্ণ সরঞ্জাম, প্রস্তুতিরও অভাব আছে। অনেক সময় কর্তৃপক্ষ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাল্টিমিডিয়ার সরঞ্জাম পাঠিয়ে দায়িত্ব শেষ করে, সেটি ব্যবহারের উপযুক্ত শিক্ষক ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আছে কি না, তা খতিয়ে দেখে না। হিসাববিজ্ঞানের শিক্ষকেরা সর্বোচ্চ মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করেন, ৩০ শতাংশ। ইংরেজি ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ, জীববিজ্ঞানের ২৩ দশমিক ৯ ও পদার্থবিজ্ঞানের ২০ শতাংশ শিক্ষক পাঠদানের মাধ্যম হিসেবে মাল্টিমিডিয়া ব্যবহার করে থাকেন।
এসব তথ্য মাধ্যমিক শিক্ষার রুগ্ণ ও দুর্বল চিত্রই তুলে ধরে। শিক্ষাবিদেরা মনে করেন, অপেক্ষাকৃত কম মনোযোগী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসেন, বেশি মনোযোগীরা আসেন না। সে ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে এই ঘাটতি মেটানো যেতে পারে। কিন্তু যখন বেশির ভাগ শিক্ষক প্রশিক্ষণের বাইরে থাকেন, তখন এ বিষয়ে সরকারের উদাসীনতাই প্রমাণিত হয়। শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ না থাকায় তাঁরা নোট ও গাইড বইয়ের প্রতি অধিক নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন।
সেই সঙ্গে প্রাইভেট টিউশন তো আছেই। এ অবস্থায় শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষে প্রয়োজনীয় পাঠ গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হবে, সেটাই স্বাভাবিক। শিক্ষাক্রম, শিক্ষানীতি ও এসডিজির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষকদের অজ্ঞতা উদ্বেগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেয়।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী শিক্ষার গুণগত মান বাড়াতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনার কথা বলেছেন। কিন্তু সেটি কবে বা কীভাবে বাস্তবায়িত হবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি। আমরা মনে করি, এ বিষয়ে নির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দেওয়া উচিত। মাধ্যমিক পর্যায়ে
শিক্ষার দুরবস্থা কাটাতে অবিলম্বে শিক্ষকদের বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করতে হবে।