ইসলামের শিক্ষা নবীনে স্নেহ ও প্রবীণে শ্রদ্ধা
শৈশব ও বার্ধক্য প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। শৈশব ও বার্ধক্য মানবজীবনের এক অনিবার্য বিধান। শৈশব ও বার্ধক্য সৃষ্টির সূচনা ও পূর্ণতার উদাহরণ। কোরআন মাজিদে এই উভয়ের স্বরূপ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহ, যিনি তোমাদের সৃষ্টি করেছেন দুর্বল অবস্থায়, দুর্বলতার পর তিনি দেন শক্তি, শক্তির পর আবার দেন দুর্বলতা ও বার্ধক্য। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান।’ (সুরা-৩০ রুম, আয়াত: ৫৪) শৈশবে মানুষ দুর্বল থাকে, বার্ধক্যেও দুর্বলতার দিকেই ফিরে আসে। বার্ধক্য মানেই নানাবিধ দুর্বলতা। বার্ধক্যপীড়িত মানুষের প্রতি যত্নবান হওয়া ও সহানুভূতিশীল হওয়া খোদার বিধান।
ইসলাম মানবকল্যাণের বিধান। মনুষ্য সভ্যতার ও সমাজের সুখ, শান্তি–সম্প্রীতি, স্থিতি, সমৃদ্ধি, উন্নয়ন ও অগ্রগতি এর লক্ষ্য। যার সুফল প্রতিফলিত হবে ব্যক্তিজীবনে ও আচরণে, দ্বৈত বা যৌথ কর্মে, দাম্পত্য জীবনে, পরিবারে, সমাজে, জাতিতে, প্রশাসনে ও রাষ্ট্রে এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে।
শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার মানবজীবনের অলংকার। গর্ব, অহমিকা ও দুরাচার কলঙ্ক ও অন্ধকার। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা আমল করে নাও এসবের আগেই। ওই দারিদ্র্য, যা আত্মবিস্মৃত করে দেয়, ওই প্রাচুর্য যা দাম্ভিক করে তোলে, ওই রোগব্যাধি যা জরাগ্রস্ত করে ফেলে, ওই বার্ধক্য যা বুদ্ধিহীন করে ছাড়ে।’ (তিরমিজি শরিফ, হাদিস: ২৩০৬) রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘তোমরা পাঁচটি জিনিসের আগে পাঁচটি জিনিসের মূল্যায়ন করো। যৌবনকে বার্ধক্যের আগে, অবসরকে ব্যস্ততার আগে, সুস্থতাকে অসুস্থতার আগে, জীবনকে মৃত্যুর আগে।’ (তিরমিজি ও আবুদাউদ)
উন্নত ও সুশীল সমাজ গঠনে প্রয়োজন পরিবারব্যবস্থা ও সৌজন্যবোধ, আদব-আখলাক, তাহজিব-তমদ্দুন, শিক্ষা-সংস্কৃতি। আল্লাহ তাআলা কোরআন মাজিদে বলেন, ‘তোমার প্রতিপালক আদেশ দিয়েছেন, তিনি ব্যতীত অন্য কারও ইবাদত না করতে ও পিতা-মাতার প্রতি সদ্ব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়েই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধক্যে উপনীত হলে তাদেরকে উফ্ বলো না এবং তাদেরকে ধমক দিয়ো না; তাদের সঙ্গে সম্মানসূচক কথা বলো। মমতাবশে তাদের সামনে নিজেকে বিনয়াবনত করো এবং বলো, “হে আমার প্রতিপালক! তাদের প্রতি দয়া করো, যেভাবে শৈশবে তারা আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন”’ (সুরা-১৭ বনি ইসরায়েল, আয়াত: ২৩-২৪)। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘বাবা-মায়ের সঙ্গে সদাচারের একটি দিক হলো, বাবা–মায়ের বন্ধুস্থানীয় ও সমবয়সীদের সঙ্গে সদাচার ও সুসম্পর্ক রাখা।’ (মুসলিম শরিফ, পঞ্চম খণ্ড)
বলা বাহুল্য, এটা নবীন ও প্রবীণের মধ্যে সুসম্পর্ক ও সদাচারের এক অতুলনীয় ব্যবস্থা।
ইসলামের এই মহতী শিক্ষাগুলো আমাদের পূর্বসূরিদের বাস্তব জীবনে বিদ্যমান ছিল বলেই তাদের জীবন মানবতা ও মানবিকতায় উদ্ভাসিত ছিল। তাঁরা যেমন প্রবীণদের সেবা ও সম্মান করেছেন, তেমনি নিজের বার্ধক্যেও তাঁরা পেয়েছেন নবীন প্রজন্মের অপরিমেয় সম্মান ও সেবা।
ছোটদের প্রতি স্নেহ–ভালোবাসা সভ্যতা সুরক্ষার জন্য অপরিহার্য। যারা বয়সে বা অবস্থানে ছোট, তাদের প্রতি স্নেহ-মমতা প্রয়োজন। সুবিধাবঞ্চিত ও এতিম অসহায় শিশুদের তা আরও বেশি প্রয়োজন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে এতিম ও অসহায়কে সম্মান করল, সে আমাকেই সম্মান করল।’ (তিরমিজি)
আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তুমি কি তাদের দেখেছ? যারা বিচার ও কর্মফল অবিশ্বাস করে! তারা ওরা যারা এতিমকে ধাক্কা দেয়, তারা অভাবীদের খাদ্যদানে উৎসাহ দেয় না। দুর্ভোগ ওই সব নামাজির জন্য, যারা তাদের নামাজে উদাসীন; যারা লোকদেখানো কাজ করে এবং পরোপকারে বাধা সৃষ্টি করে।’ (সুরা-১০৭ মাউন, আয়াত: ১-৭)
সারা পৃথিবীর সব মানুষ ও সব বস্তু দুই শ্রেণি বিভাগে বিভাজিত—ছোট ও বড়, অনুজ ও অগ্রজ—এর বাইরে কেউ নেই; কিছুই নেই। এই বড় ও ছোট হতে পারে সময়ের ব্যবধানে, হতে পারে শক্তি, সম্মানে ও অবস্থানে বা পদমর্যাদায়। সবাই সহযাত্রী হয়ে নির্বিঘ্নে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ছোট ও বড় একে অন্যের সাহায্য–সহযোগিতা প্রয়োজন। তাই আমাদের নিজেদেরই স্বার্থে আমাদের সবার উচিত বড়কে সম্মান করা ও ছোটকে স্নেহ করা। এই একটি মাত্র সূত্র অনুসরণ করলেই জীবন ও জগতের বহু জটিল সমস্যা এমনি এমনিই সমাধান হয়ে যায়।
মানবতার মহান শিক্ষক প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যে ছোটকে স্নেহ করে না এবং বড়কে সম্মান করে না, সে আমার উম্মত নয়।’ (আবু দাউদ ও তিরমিজি)
আসুন আমরা নবীজির প্রকৃত উম্মত থেকে জীবনকে সাজাই স্নেহ, মায়া–মমতা, প্রীতি, অনুরাগ, অনুকম্পা, দয়া, করুণা, প্রেম, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা
ও ভক্তিতে।
শাঈখ মুহাম্মাদ উছমান গনী: বাংলাদেশ জাতীয় ইমাম সমিতির যুগ্ম মহাসচিব ও আহ্ছানিয়া ইনস্টিটিউট অব সুফিজমের সহকারী অধ্যাপক
[email protected]