রবার্ট মুগাবে: স্বাধীনতাকামীর স্বৈরাচার কি ভালো?
রবার্ট মুগাবের জন্য কি ভালোবাসা, না ঘৃণা অথবা মৃদু সমালোচনা—কোনটি বরাদ্দ করা উচিত? মুগাবের জন্য সবগুলোই আছে। এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী মুগাবে। কখনো তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতীয়তাবাদী বিপ্লবের মার্ক্সবাদী নেতা, কখনো বিরোধী দলকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া কর্তৃত্ববাদী এক নিষ্ঠুর শাসক। কারও মতে, মুগাবের হাত ধরে জিম্বাবুয়ের সৃষ্টি। আবার তাঁর হাতেই ধ্বংসের পথে গিয়েছে জিম্বাবুয়ে। মুক্তিকামী জনতার নেতা থেকে স্বৈরাচারী কর্তৃত্ববাদী নেতায় পরিণত হয়েছিলেন মুগাবে। ৬ সেপ্টেম্বর মৃত্যু হয় আফ্রিকার দেশ জিম্বাবুয়ের এই স্বৈরশাসকের।
যেভাবেই মুগাবেকে চিহ্নিত করা হোক না কেন, উপনিবেশ–উত্তর যুগে আফ্রিকার জাতীয়তাবাদী নেতাদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন মুগাবে। প্রথম জীবনে জিম্বাবুয়ে ও ঘানায় শিক্ষকতা করতেন। শিক্ষকতা করতে গিয়ে আফ্রিকার স্বাধীনতাকামী নেতাদের দ্বারা প্রভাবিত হন। মুগাবে যখন রাজনীতিতে আসেন তখন পৃথিবীজুড়েই উপনিবেশবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে। স্বভাবতই মুগাবেও স্বাধিকার আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। ঘানা, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ বিভিন্ন দেশের মার্ক্সবাদী নেতাদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে তোলেন। আফ্রিকান জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে কালো মানুষদের মধ্যে সমাজতন্ত্রের জাগরণ সৃষ্টি করেন। শিক্ষকতা থেকে মার্ক্সবাদী রাজনীতিতে দীক্ষা নেওয়া মুগাবে বলতেন, ভোট ও বন্দুক একসঙ্গে চলবে। ইউরোপীয় দখলদারদের বিরুদ্ধে জিম্বাবুয়ের জনসাধারণকে স্বাধীনতায় উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি। কিন্তু মুগাবের ছন্দপতন ঘটেছিল। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার একধরনের প্রবণতার উপস্থিতি মুগাবের ভেতর দেখা যায়। ৩৭ বছর একহাতে শাসন করেছেন জিম্বাবুয়ে। নিজের স্ত্রীকে পরবর্তী নেতা হিসেবে নির্ধারিত করেছিলেন। এ ছাড়া অর্থনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য তিনি সমালোচিত হন পশ্চিমাদের দ্বারা।
মুগাবে কিন্তু গত শতকের আরও অনেক জাতীয়তাবাদী নেতার ঘরানা থেকে বের হতে পারেননি। বিপ্লবের ডাক দিয়ে ক্ষমতায় এসে কেবলই ষড়যন্ত্র দেখেছেন। বিরোধী মতকে কঠোরভাবে দমন করেছেন, সাম্রাজ্যবাদের দালাল হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ভোট কারচুপির অভিযোগও করেছে পশ্চিমা গণমাধ্যম। জিম্বাবুয়ের অনেকেই যখন অভুক্ত, তিনি বিশাল কেক কেটে নিজের জন্মদিন উদ্যাপন করেছেন। এসব কিছু তাঁকে একনায়কত্বের দিকে নিয়ে যায়।
গত শতকে বেশ কয়েকজন জাতীয়তাবাদী একনায়কের আবির্ভাব ঘটে উপনিবেশবিরোধী স্বাধিকার আন্দোলনের পথ ধরে। বিপ্লবের নাম করে শেষ দিকে স্বৈরশাসন কায়েম করেছেন নিজ নিজ দেশে। কেউ কেউ স্বৈরশাসন ছাড়িয়ে ফ্যাসিবাদ পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিলেন। যেই শোষণ–জুলুমের প্রতিবাদ করে রাজনীতির মঞ্চে উত্থান, নাগরিকের অধিকার আদায়ের জন্য আজীবন লড়াই–সংগ্রাম করেছেন, তাঁরাই আবার শাসন ক্ষমতা হাতে পেয়ে নাগরিক অধিকার নিজেরাই কেড়ে নিয়েছেন। যেখানে–সেখানে অদৃশ্য শত্রু খুঁজে বেড়িয়েছেন। এক অজানা ভয় যেন তাঁদের তাড়া করত। তাঁরা কখনোই জনগণের ওপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হতে পারেননি। ক্ষমতার পালাবদলে তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। জার্মানির অ্যাডলফ হিটলারও জাতীয়তাবাদী সমাজতন্ত্রের কথা বলেই ক্ষমতায় এসেছিলেন। তাঁরা সবাই একই ধাঁচের রাজনীতি করার চেষ্টা করেছেন। শুরুতে স্বাধীনতার কথা, শেষ দিকে ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার প্রবণতা। রাজনীতির পারিবারিকীকরণের চেষ্টা। অনেকটা রাজার ছেলেই রাজা হবে। তা সে যেকোনো উপায়েই হোক।
জাতীয়তাবাদীরা কীভাবে স্বৈরশাসকে পরিণত হন, মুগাবের রাজনৈতিক জীবন তার চমৎকার উদাহরণ। ব্রিটিশ উপনিবেশ দক্ষিণ রোডেশিয়ার এক কাঠমিস্ত্রির ঘরে মুগাবে জন্ম নেন ১৯২৪ সালে। বেড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে দেখেছেন দারিদ্র্যের সঙ্গে নিরন্তর লড়াই। শাসকগোষ্ঠীর বর্ণবাদী আচরণ। মুগাবে জানতেন, কালোদের জন্য শিক্ষা ও চাকরির তেমন সুযোগ নেই। তারপরও তিনি উচ্চশিক্ষা অর্জন করেন। জিম্বাবুয়ে আফ্রিকান ন্যাশনাল ইউনিয়ন (জানু) গঠন করে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলায় ১১ বছর জেলও খাটেন তিনি। পরবর্তী সময়ে ১৯৮০ সালে জিম্বাবুয়ের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন মুগাবে। ক্ষমতায় আরোহণের পরপরই তিনি শিক্ষক ও চিকিৎসকদের গ্রামে পাঠিয়ে দেন আর দশজন মার্ক্সবাদী শাসকের মতোই। কৃষি উৎপাদনে জোর দেন। কোনো কিছুকেই তোয়াক্কা করেননি মুগাবে। তবে তাঁর ভূমিসংস্কার কর্মসূচি প্রবলভাবে পশ্চিমাদের দ্বারা সমালোচিত হয়েছে। ১৯৯৮ সালে মুগাবে উপনিবেশ আমলে দখল হয়ে যাওয়া জমি উদ্ধারে মনোযোগী হন এবং এসব জমি উদ্ধার করে স্থানীয় আফ্রিকানদের হাতে ফিরিয়ে দেন। পশ্চিমারা অভিযোগ করেছে, আফ্রিকানরা ইউরোপীয়দের খামার জোর করে দখল করে নিয়েছে ভূমিসংস্কারের নামে। এর জন্য পশ্চিমারা জিম্বাবুয়ের ওপর বিভিন্ন আর্থিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে।
ভূমিসংস্কারের পক্ষে মুগাবের বক্তব্য ছিল পরিষ্কার। বিভিন্ন সময় মুগাবে বলেছেন, ‘এই জমি আমাদের। ব্রিটিশরা উপনিবেশ স্থাপন করে আমাদের জমি কেড়ে নিয়েছিল। উপনিবেশ যুগের রক্তাক্ত দিনের কথা আমরা ভুলে যাইনি। ভূমিসংস্কার সেই ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধেই লড়াই। এ নিয়ে ব্রিটিশরা যেন কথা বলতে না আসে।’
মুগাবে চেয়েছিলেন ইউরোপীয় বংশোদ্ভূত কৃষকদের হাত থেকে জমি উদ্ধার করে আফ্রিকানদের হাতে কৃষির নেতৃত্ব ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু এতে করে অর্থনীতির ওপর চাপ পড়ে বিভিন্ন পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কারণে। ইউরোপ, আমেরিকা, জাতিসংঘ—সবাই একযোগে মুগাবের জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে মাঠে নামে। এককথায় বিপর্যয় নেমে আসে জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে। খাদ্য উৎপাদন ব্যাহত হয়। পশ্চিমা সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের শিকার হয় জিম্বাবুয়ে। চরম এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় জিম্বাবুয়ের অর্থনীতিতে। এতে করে স্থানীয় আফ্রিকানরাও মুগাবের ওপর বিরক্ত হতে শুরু করেন। স্থানীয় এবং বাইরে—সব দিকেই সমর্থন হারান মুগাবে।
পশ্চিমের উদ্দেশ্যই ছিল জনসাধারণকে মুগাবের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলা। এই দিক থেকে পশ্চিমারা সফল। অসংখ্যবার হত্যাচেষ্টা প্রতিহত করলেও পশ্চিমাদের রাজনীতির জালে আটকা পড়েন মুগাবে। একটি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র মুগাবে গঠন করতে পারেননি। মুগাবের বিরুদ্ধে বিরোধী মত দমনের পাশাপাশি আরও বড় অভিযোগ হলো দুর্নীতি। অভিযোগ করা হয়, মুগাবের নিজস্ব লোকজন আকণ্ঠ দুর্নীতিতে মজেছিলেন। এসব ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বিক্ষোভের মুখে এক সিভিল-সামরিক অভ্যুত্থানে কিংবদন্তির এই নেতা ২০১৭ সালে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। কিন্তু রেখে যান এক অগোছালো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিত্তি।
মুগাবে কারও কাছে নায়ক আর পশ্চিমাদের কাছে খলনায়ক। মুগাবের ব্যাপারে স্থির উপসংহারে পৌঁছানো মুশকিল। মুগাবে সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সাধারণ্যে খুব একটা পৌঁছায় না। পুঁজিবাদী পশ্চিমা গণমাধ্যম তাঁকে নির্মম, জাতিবিদ্বেষী শাসক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। একপক্ষীয় তথ্যের ভিত্তিতে কখনোই ইতিহাস রচিত হতে পারে না। হয় না। সব সফল রাজনৈতিক নেতাই সফল শাসক হতে পারেন না। মুগাবেও তেমনই একজন রাজনৈতিক চরিত্র। শাসক হিসেবে তিনি সফল হতে পারেননি, স্বাধীনতাকামী নেতা হিসেবে যতটা ছিলেন।
ড. মারুফ মল্লিক: ভিজিটিং রিসার্চ ফেলো, ইনস্টিটিউট অব ওরিয়েন্ট অ্যান্ড এশিয়ান স্টাডিজ, ইউনিভার্সিটি অব বন।