শুধু একটি জেলাতেই (নারায়ণগঞ্জ) এক হাজারের বেশি অস্ত্রের ছাড়পত্রের ঘটনা দেশের সামগ্রিক চিত্র সম্পর্কে উদ্বেগ জাগিয়ে তোলে। প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, সারা দেশে এ মুহূর্তে কত বৈধ অস্ত্র কত মানুষের কাছে আছে? অস্ত্রপ্রতি বছরে সর্বোচ্চ ১০০টি গুলি ক্রয়ে কোনো অপব্যবহার ঘটছে কি না, সেই প্রশ্ন নাকচ করা যাবে না। বৈধ অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়ে কর্তৃপক্ষের নিবিড় নজরদারি এবং প্রতিকারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে যে বড় ধরনের ঘাটতি চলছে, তা স্পষ্ট।
নারায়ণগঞ্জে অস্ত্রের লাইসেন্স নিয়ে প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, সেখানকার একটি প্রভাবশালী পরিবারের ছত্রচ্ছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের ফৌজদারি রেকর্ড প্রকাশ না করেই লাইসেন্স নিতে এবং তার নবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছেন। অথচ তাঁদের কারও কারও ফৌজদারি অপরাধে সংস্রব থাকা বিচিত্র নয়।
দেশে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেসরকারি নিরাপত্তা সংস্থার বিস্তার ঘটছে। ২০০৬ সালের বেসরকারি নিরাপত্তা সেবা আইনের অধীনে অস্ত্রের জন্য দরখাস্তকারীকে যেসব তথ্য দিতে হয়, সেগুলো কঠোরভাবে যাচাই করা হলে বর্তমানে যাঁদের হাতে লাইসেন্স আছে, তাঁদের পক্ষে তা বজায় রাখা কঠিন হবে বলেই প্রতীয়মান হয়। আবেদনকারী ব্যক্তি বা কোম্পানিকে অবশ্যই কর ও মূসকদাতা হতে হবে। ঋণখেলাপি হওয়া চলবে না। অন্তত দুই বছরের জন্য কোনো দণ্ডিতকে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে পাঁচ বছর অতিবাহিত হতে হবে। অথচ ব্যক্তি হিসেবে যঁারা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে অস্ত্রের লাইসেন্সের জন্য দরখাস্ত করেন, তখন এই শর্তগুলো মানার কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। সেখানে একজন ব্যক্তিকে ২২টি তথ্য দিতে হয়, যার মধ্যে ওই ধরনের কোনো তথ্য দিতে হয় না। এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। কারণ, এতে কোনো অপরাধী সহজেই তার কুকীর্তি গোপন করে বৈধভাবে অস্ত্রের মালিক হতে পারে।
বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার ঠেকাতে সরকার ২০১৬ সালে একটি নীতিমালা করেছিল। এর দুটি বিধান সমর্থনযোগ্য অথচ ২০০৬ সালের ওই আইনে নেই। যেমন নীতিমালা বলছে, কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা বিচারাধীন থাকলে বা কেউ ফৌজদারি আদালত থেকে চূড়ান্ত সাজাপ্রাপ্ত হলে ১০ বছরের মধ্যে লাইসেন্স পাবেন না।
আমরা মনে করি, ২০০৬ সালের আইন এবং ২০১৬ সালের নীতিমালাসহ অস্ত্রসংক্রান্ত সমগ্র বিধিবিধান পর্যালোচনা করে তাতে দরকারি সংস্কার আনা সময়ের দাবি। ব্যক্তি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা উদ্বেগ ও চাহিদাকে অবশ্যই অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ, দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর পক্ষে সব ক্ষেত্রে ও সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা অসম্ভব। অন্যদিকে এ সংস্থাগুলোর দক্ষতা ও নিরাপত্তা সেবার মান নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। এ বাস্তবতায় বেসরকারি খাতের ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা চাহিদার বিষয়টি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। আমরা অতীতে বিভিন্ন সময়ে দেখেছি যে এ বিষয়ে মাঝেমধ্যে অস্থায়ী বা খণ্ডিতভাবে কিছু উদ্যোগ নেওয়া হলেও এ বিষয়ে একটি সম্পূর্ণ বিধিব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আশ্বস্ত করেছেন যে সারা দেশে দেওয়া বৈধ অস্ত্রের লাইসেন্সের বিষয়টি অনলাইনে আনা হবে। আমরা তঁার এ ঘোষণাকে স্বাগত জানাই। কারণ, স্বচ্ছতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে একটা কার্যকরী সুরক্ষা। তবে শুধু অনলাইন তথ্যভান্ডার গড়ে তোলাই যথেষ্ট নয়। বৈধ অস্ত্রের চাহিদা নিরূপণ এবং লাইসেন্সদানসংক্রান্ত আইন ও বিধিবিধানকে সময়োপযোগী করা দরকার। সারা দেশের অবস্থা কী এবং কী করণীয়, সেটা নির্দিষ্ট করতে নারায়ণগঞ্জের অভিজ্ঞতা উপকারে আসতে পারে। তাই নারায়ণগঞ্জে কে কীভাবে অস্ত্র পেল, তার ওপর যত দ্রুত সম্ভব একটি তদন্ত জরুরি।