ঈদুল আজহা সমাগত। উৎসবকে উপলক্ষ করে ‘স্বজনসাহচর্যব্যাকুল’ মানুষ আক্ষরিক অর্থেই ঝুঁকিসংকুল পথে ‘দেশের বাড়ি’ ফিরছে। এই ‘বাড়ি ফেরা’ দৃশ্যত এবং কার্যত নির্বিঘ্ন ও নিরুদ্বিগ্ন নয়। কারণ, প্রাকৃতিক ও মনুষ্যকৃত—এই দুই ধরনের দুর্যোগের মধ্য দিয়ে দেশবাসী উৎসবমুখী।
একদিকে উত্তরাঞ্চলের বন্যা ও দেশব্যাপী ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপের মতো বিপর্যয়ে সবাই উদ্বেগাকুল। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ভাঙাচোরা রাস্তাঘাট, মহাসড়কে কোরবানির পশুর ট্রাকে বেশুমার চাঁদাবাজি, ধারাবাহিক গণপিটুনি ও খুন-ধর্ষণের উল্লম্ফনের মতো মনুষ্যকৃত বিপর্যয়ে জনজীবন বিপর্যস্ত। সার্বিক বিবেচনায় আসন্ন ঈদ উৎসবের সর্বাঙ্গীণ ও স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যাপনের অনুকূল প্রতিবেশ স্পষ্টতই অনুপস্থিত।
আপাতদৃষ্টে প্রকৃতিই দেশের বন্যা ও ডেঙ্গুর চলমান বিধ্বংসী চিত্রের স্রষ্টা। কিন্তু আদতে প্রকৃতি একা নয়, মানুষও এই দৃশ্যের স্রষ্টা। যুগ্ম স্রষ্টা। গভীরতর সত্যটি মনে রাখা দরকার, এসব দুর্যোগ প্রাকৃতিক বটে, কিন্তু তার ক্ষয়ক্ষতি বহুলাংশে প্রাকৃতিক নয় বরং মানুষের নিজের তৈরি। বন্যার ক্ষয়ক্ষতি এবং ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে এখন পর্যন্ত সরকারের নেওয়া উদ্যোগকে প্রশংসা করা যায় না।
গাঙ্গেয় এই ভূখণ্ডে শ্রাবণ মাসে অতিবর্ষণ হতে পারে এবং এতে মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যান চলাচলের অনুপযোগী হতে পারে—এর চেয়ে ‘স্বাভাবিক আশঙ্কা’ খুঁজে পাওয়া কঠিন। তারপরও সড়কে শঙ্কামুক্ত যান চলাচল নিশ্চিতে সরকারের ‘শ্রীমুখ নির্গত’ শুষ্ক আশ্বাস ব্যতীত তেমন কোনো পদক্ষেপ প্রতিভাত হচ্ছে না।
গরুর ট্রাকে চাঁদাবাজি বরদাশত করা হবে না—ক্ষমতাসীন নেতা ও পুলিশ কর্মকর্তাদের এই মুহুর্মুহু হুমকি সত্ত্বেও চাঁদাবাজি বন্ধের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। তবে অন্যবারের সঙ্গে এবারের দৃশ্যমান পার্থক্য হলো, আগে মহাসড়কে গরুর ট্রাক থেকে পুলিশকে চাঁদা নিতে দেখা যেত, এবার তা দেখা যাচ্ছে না। বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের লোক ট্রাকের গতিরোধ করে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। মানসিক ভারসাম্যহীন মানুষসহ বেশ কয়েকজন নিরপরাধ নারী–পুরুষকে ছেলেধরা সন্দেহে পৈশাচিক উন্মাদনায় গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করা এবং একের পর এক শিশু ধর্ষণ ও হত্যার খবরে মানুষ প্রবলভাবে উদ্বিগ্ন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সন্তোষজনক বলার সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। সব মিলিয়ে জাতি যেন একটি প্রপঞ্চময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রাকৃতিক ও মনুষ্যকৃত দুর্যোগের মধ্য দিয়ে আবর্তিত হচ্ছে সময়।
যেহেতু দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকা সরকারের নিতান্ত আবশ্যিক কর্তব্য, সেহেতু সেই কর্তব্য তাকেই পালন করতে হবে। ডেঙ্গু দমনে ব্যর্থতার ‘মাছ’ মশকবিনাশী ওষুধের আশু আমদানির ‘শাক’ দিয়ে ঢাকার চেষ্টা না করে আন্তরিক উদ্যোগ নিলে মানুষ আশ্বস্ত হবে। দেশবাসী জানে, রক্ষাকবচ সব সময় দুর্ভেদ্য হয় না। কিন্তু চেষ্টা জারি রাখতে হবে। সেই চেষ্টা অকৃত্রিম ও আন্তরিক হলে জনগণ তা উপলব্ধি করতে পারবে এবং তারাও তাতে শামিল হবে।
ফি বছর ঈদের ঠিক আগে ও পরে সড়ক ও নৌ দুর্ঘটনায় ‘নিয়মিত ভিত্তিতে’ বহু মানুষের মৃত্যু হয়। যাত্রীবাহী বাসের বেপরোয়া গতি ও নৌযানের মাত্রাতিরিক্ত যাত্রীবহন এই দুর্ঘটনার মূল কারণ। রোগের কারণ যেহেতু জানা, সেহেতু তার উপশম কঠিন হওয়ার কথা নয়। এই অতিরিক্ত যাত্রীবহন ও বেপরোয়া গতি সংবরণে চালকদের বাধ্য রাখা প্রশাসনের কর্তব্যের মধ্যে পড়ে।
সরকার চলমান সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ও সঠিক পথে এগোচ্ছে—অন্তত এই আস্থাটুকু পেলে মানুষের কাছে ঈদের আনন্দ নতুন ঔজ্জ্বল্যে তাদের কাছে ধরা দিত। উৎসবের দুশ্চিন্তামুক্ত উদ্যাপন তাদের অধিকার। শুধু ‘কিল মারার গোঁসাই’ হলে চলবে না, দেশবাসীর অভিভাবক হিসেবে সরকারকে সেই অধিকার সুরক্ষা করতেই হবে।