উচ্চশিক্ষায় ভর্তি পরীক্ষা হোক রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে
শিক্ষার মানোন্নয়নে ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ শীর্ষক একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে বর্তমান সরকার, যার মেয়াদ ৫ বছর। বাস্তবায়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ৩৭ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের আওতায় দেশের ষষ্ঠ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর পাবলিক পরীক্ষার ফি, টিউশন ফি, বইকেনা ও উপবৃত্তি দেবে সরকার। থাকছে স্টকহোল্ডারদের প্রশিক্ষণ ও ওরিয়েন্টশন কর্মসূচিও। টেকসই শিল্পোন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি শুভ উদ্যোগ, যা বাস্তবায়িত হলে হয়তো আমাদের শিক্ষার মান বাড়বে আর কমবে ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যাও।
আমরা বিশ্বাস করি, শিক্ষা কার্যক্রম কখনোই বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত হতে পারে না। যদিও দীর্ঘদিন ধরে আমাদের শিক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, বসেছে শিক্ষার ওপর করও। এরই ধারাবাহিকতায় ভর্তি পরীক্ষা হয়ে উঠেছে একটি অতিবাণিজ্যিক প্রক্রিয়া। আমরা যখন গুচ্ছপদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষার কথা বলছি, তখন তার প্রত্যুত্তরে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রতিদিন ভর্তি ব্যয় বাড়িয়ে এবং নতুন নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করে পুরো প্রক্রিয়াকে জটিল ও অমানবিক করে তুলছে। আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্তশাসনের দোহাই দিয়ে সেই গুচ্ছপদ্ধতির ভর্তিপ্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করতে দিচ্ছে না। যদিও আশার কথা হলো, এবারই প্রথমবারের মতো কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সমন্বিতভাবে ভর্তি পরীক্ষা আয়োজন করতে যাচ্ছে। নিশ্চয়ই এই সামান্য আশার আলো শিগগিরই ছড়িয়ে পড়বে দেশের সমগ্র ভর্তিপ্রক্রিয়ায়।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপ্রক্রিয়া অতি নিষ্ঠুর ও অতিবাণিজ্যিক, যা দেখার কেউ নেই। স্বায়ত্তশাসনকে কাজে লাগিয়ে যেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য অসংখ্য মঙ্গলচিন্তা করা যেত, সেখানে প্রতিদিন তাঁদের এক কণ্টকাকীর্ণ পথে ঠেলে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। ভর্তিপ্রক্রিয়াকে করে তুলছে জটিল ও ব্যয়বহুল। এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৫০ টাকা, গত বছর যা ছিল ৩৫০ টাকা। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রাথমিক আবেদনমূল্য গত বছর ছিল ৫৫ টাকা এবং চূড়ান্ত আবেদনমূল্য ১ হাজার ৯৮০ টাকা, যা এবারও অপরিবর্তিত থাকতে পারে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ভর্তির আবেদনমূল্য ছিল ৩৫০ টাকা থেকে ৫৫০ টাকা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল ৫৫০ টাকা, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদনের প্রাথমিক মূল্য ছিল ১০০ টাকা ও চূড়ান্ত মূল্য ৫০০ টাকা, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) ছিল ৯০০-১ হাজার ১০০ এবং মেডিকেলে ভর্তির আবেদনমূল্য ছিল ১ হাজার টাকা। অন্যদিকে, এ বছর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আবেদনমূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ২৫০ টাকা।
যদি একজন শিক্ষার্থী ওপরে উল্লিখিত কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কেবল একটি ইউনিটে আবেদন করেন, তবে তাঁকে শুধু ফি বাবদই গুনতে হচ্ছে ৬ হাজার ১৮০ টাকা, যা অনেকাংশেই পরীক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত কষ্টের, যা আমাদের আর্থসামাজিক ব্যবস্থার সঙ্গে অতি অসংগতিপূর্ণ এবং আমাদের প্রকৃত মেধাবীদের উচ্চশিক্ষা থেকে পিছিয়ে রাখার একটি দুষ্ট প্রক্রিয়ামাত্র। পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীকে যাতায়াত, থাকা ও খাওয়া বাবদ আরও একটি মোটা অঙ্কের টাকা গুনতে হয়। পরীক্ষাপ্রতি সেটিও প্রায় হাজার দুয়েক টাকার কম নয়। যদি তাঁরা একাধিক ইউনিটে কিংবা আরও অধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপ্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে চান, তাহলে ব্যয়টা আরও বাড়ে। কখনো কখনো তা গিয়ে দাঁড়ায় ২০-২৫ হাজার টাকা। এখন প্রশ্ন হলো, কীভাবে একজন স্বল্প আয়ের মানুষ তাঁর সন্তানকে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ জোগান দেবেন? প্রশ্ন জাগে, কবে আমাদের ভর্তিপ্রক্রিয়া বাণিজ্যের থাবা থেকে মুক্তি পাবে?
ধরে নেওয়া যাক, কোনো একটি ভর্তি পরীক্ষায় মাত্র ১০ হাজার পরীক্ষার্থী অংশগ্রহণ করছেন এবং ভর্তির আবেদনমূল্য ৫০০ টাকা। তাহলে মোট আয় দাঁড়াবে প্রায় অর্ধকোটি টাকা। ব্যয়ের খাতগুলো খুবই সুস্পষ্ট। ওএমআর ক্রয় ও রিডিং জনপ্রতি বাবদ ১০ টাকা, কেন্দ্র ব্যবস্থাপনা ও পরিদর্শন ব্যয় জনপ্রতি ৪০ টাকা, বিবিধ ক্রয় ও আপ্যায়ন ৫০ হাজার টাকা (জনপ্রতি হার ৫ টাকা), ২০ জন শিক্ষককে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা হারে ৫ দিন ঘণ্টায় ১ হাজার ৫০০ টাকা করে সম্মানী প্রদান করা হয়, তাহলে ১৫ লাখ টাকা (জনপ্রতি হার ১৫০ টাকা)। যদি ২০ জন কর্মকর্তা–কর্মচারীকে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা হারে ৫ দিন ঘণ্টায় ২০০ টাকা করে প্রদান করা হয়, তাহলে ২ লাখ টাকা (জনপ্রতি হার ২০ টাকা) এবং বিজ্ঞাপন, প্রচার, আইটি ও বিবিধ খাতে সর্বোচ্চ জনপ্রতি ১০ টাকা ব্যয় হতে পারে। অতএব, খরচগুলো সাকল্যে দাঁড়ায় ২৩৫ টাকা। উদ্বৃত্ত ২৬৫ টাকা। পরীক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লে এই উদ্বৃত্তের পরিমাণ আরও বাড়বে। কোথায় যাচ্ছে এই উদ্বৃত্ত ২৬৫ টাকা? কেন আমরা একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছি? চাইলেই কী একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান ভর্তি পরীক্ষার নামে এ ধরনের নিকৃষ্ট বাণিজ্য করতে পারে? প্রশ্নের উত্তরগুলো দীর্ঘদিন ধরে অজানা। বিষয়টি আরও দুঃখজনক হয় যখন ইউজিসির নির্দেশনায় ভর্তি পরীক্ষার আয়ের ৪০ শতাংশ অর্থ জমা দিতে হয় রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। কিন্তু কেন? তাহলে কী বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা সরকার স্বীকৃত একটি লাভজনক ব্যবসা?
প্রশ্নগুলো যখন আমাদের তাড়িত করে, ব্যথিত করে, তখন আমাদের সামনে উদাহরণ হতে পারে সরকারের ‘সেকেন্ডারি এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’, যার আওতায় সরকার উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর জন্য বিনা মূল্যে শিক্ষা ও পরীক্ষা ব্যয় বহন করতে যাচ্ছে। তার মানে, সরকার চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে বিনা ফিতে গুচ্ছ ভর্তি পরীক্ষার আওতায় আনতে পারে। আর যত দিন সেটা সম্ভব হচ্ছে না, তত দিন ভর্তি পরীক্ষা বাণিজ্যিকীকরণ হাত থেকে মুক্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সরকার শিক্ষকদের বেতন দিতে পারে, বিনা মূল্যে বই প্রদান করতে পারে, শিক্ষাকে অনেকাংশেই অবৈতনিক করতে পারে, আবাসিক শিক্ষার্থীদের শিক্ষাব্যয় বহন করতে পারে, তবে কেন বাণিজ্যিক ভর্তিপ্রক্রিয়া বন্ধ করতে পারবে না? কেন আমরা বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিপ্রক্রিয়াকে শুল্কমুক্ত করতে পারি না? কেন আমরা ভর্তিপ্রক্রিয়াকে অলাভজনক প্রক্রিয়া হিসেবে গণ্য করতে পারি না? সরকার কি পারে না ভর্তিপ্রক্রিয়াকে ব্যয়মুক্ত করতে অথবা ন্যূনতম মূল্যে সবার কাছে পৌঁছে দিতে?
একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কর্মস্থলের নিয়মিত কাজ, যেমন উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য পারিতোষিক পান, যার অর্থ আসে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে। তাহলে ভর্তি পরীক্ষার ব্যয় কেন রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহন করা সম্ভব নয়? কেন ভর্তিপ্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের পারিতোষিক রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বহন করা সম্ভব নয়? সরকার চাইলেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ভর্তির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আলাদা করে থোক বরাদ্দ দিতে পারে। এতে ভর্তি ব্যয়ের অপচয় কমবে আর শিক্ষার্থীরা পাবেন একটি অবাণিজ্যিক ভর্তিপ্রক্রিয়া, যার মধ্য দিয়ে আমাদের উচ্চশিক্ষা প্রকৃত মেধাবীদের জন্য উন্মুক্ত হবে। তবে অযাচিত পরীক্ষার্থী এড়াতে ছোট্ট একটি নামমাত্র মূল্য থাকতে পারে, যা হবে অতি নগণ্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে বাণিজ্যিক ভর্তিপ্রক্রিয়া কোনো অবস্থাতেই কাম্য নয়, বরং রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে ভর্তিপ্রক্রিয়া অধিকতর যুক্তিযুক্ত ও শিক্ষার্থীদের অধিকার।
উমর ফারুক: শিক্ষক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর
ই-মেইল: [email protected]