চলমান বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষা কার্যক্রম জরুরি ভিত্তিতে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারকে বৈষম্যহীন বাস্তবানুগ পদক্ষেপ নিতে হবে। অতীতের বন্যা-উত্তর পরিস্থিতিতে সরকারের নেওয়া উন্নয়ন ও সংস্কার কর্মসূচিগুলো স্মরণ করিয়ে দেয় যে অগ্রাধিকার নির্ধারণেই বিরাট ঘাটতি থাকে। প্রথমেই যেটা দরকার সেটা হলো, ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে যেগুলো নতুন করে তৈরি করতে হবে, সেগুলোকে আগে চিহ্নিত করা। আড়াই হাজারের বেশি কলেজ, স্কুল ও মাদ্রাসায় বন্যা তার ক্ষতচিহ্ন রেখে গেছে। কোথাও পানি নেমে যাওয়ার পর পুনরায় ক্লাস শুরু হয়েছে। কিন্তু এমন বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলো এখনো আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। সেখানে ক্লাস বন্ধ রয়েছে। এবার বন্যা এমন সময়ে আঘাত হেনেছে, যখন মাধ্যমিক ও প্রাথমিক স্কুলগুলো ষাণ্মাসিক পরীক্ষা গ্রহণের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সুতরাং শিক্ষা বিভাগের সামনে এখন আশু চ্যালেঞ্জ দুটি। এক. ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত মূল্যায়ন করা। অতীত বিবেচনায় বিশেষজ্ঞরা এটা ভেবে উদ্বিগ্ন যে বাস্তবতার নিরিখে ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করা হয় না। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ যথাযথভাবে হয় না। তেলা মাথায় তেল দেওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। এমনিতেই অন্যান্য ক্ষেত্রের অবকাঠামোগত উন্নয়নে যেভাবে বৈষম্য দেখা দেয়, সেই বৈষম্যের ধারা বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংস্কারের ক্ষেত্রেও দেখা যায়। ক্ষমতার ওপরের মহলে যাদের জোর বা প্রভাব রয়েছে, তাদের তদবির বা হস্তক্ষেপে তুলনামূলকভাবে কম ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বড় বরাদ্দ আর যাদের প্রয়োজন বেশি, তারা কম বরাদ্দ পেতে পারে। সবচেয়ে বড় ভয়, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েও কম বরাদ্দই শুধু নয়, তাদের অনেকেরই সংস্কারে অনেক বেশি দীর্ঘসূত্রতার শিকার হতে পারে। সুতরাং বন্যা-উত্তর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত সংকট মোকাবিলায় অগ্রাধিকার নির্ধারণ এবং সে অনুযায়ী হস্তক্ষেপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব প্রক্রিয়ায় যদি কর্তৃপক্ষীয় নিবিড় নজরদারি না থাকে, তাহলে অপচয় ও দুর্নীতির ব্যাপক বিস্তার ঘটতে পারে।
আরেকটি বিষয়ের প্রতি আমরা বিশেষভাবে কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। সেটি হলো স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন। উপকূলীয় অঞ্চলে স্কুল কাম সাইক্লোন শেল্টারের ধারণা সুফল দিয়েছে। সেখানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক দুই ধরনের স্কুলই আছে। এ-সংক্রান্ত অভিজ্ঞতার আলোকে সারা দেশে বন্যা হলে যেসব এলাকার মানুষের অন্তত কয়েক সপ্তাহের জন্য স্কুলে আশ্রয় নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না, তার ওপরে একটি সমীক্ষা চালানো দরকার। এর লক্ষ্য হবে এসব এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর নকশা এমনভাবে করা, যাতে এগুলোর অবকাঠামো তুলনামূলকভাবে উঁচু হয় এবং মানুষ নিরাপদে আশ্রয় নিতে পারে। আবার শিক্ষকেরা মোটামুটি ক্লাসও চালাতে পারেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরীর সঙ্গে বৃহস্পতিবার কথা বলেছি। এ বিষয়ে উপযুক্ত নির্মাণশৈলী ও নির্মাণকৌশল গ্রহণের প্রয়োজনীয়তার ওপর তিনি গুরুত্ব আরোপ করেন। বন্যায় কোথায় পানি বেশি ওঠে এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়, সেই তথ্য সরকারের তথ্যভান্ডারে আছে। কিন্তু সংকট হলো নীতি নির্ধারণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনায় তার ছাপ থাকে না।
আমরা মনে করি, অবকাঠামোগত সংস্কার অনিষ্পন্ন রেখে যেখানেই সম্ভব বিকল্প পদ্ধতিতে ক্লাস চালু করা। ক্লাস যত দিন বন্ধ থেকেছে, সেখানে অতিরিক্ত ক্লাস নিয়ে পড়াশোনার ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়া। যেসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নদীগর্ভে বিলীন বা অন্যভাবে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, সেখানে শিক্ষার্থীদের দ্রুত ক্লাসে ফেরাতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা নিতে হবে। এবারের বন্যায় কুড়িগ্রাম ও গাইবান্ধার মতো কিছু অঞ্চলের বিদ্যাপীঠ বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেগুলো বিশেষ মনোযোগের দাবিদার।