দেশের উত্তরাঞ্চলে কয়েক দিন বৃষ্টি ও বন্যার পর বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেওয়া যেত, যদি তা কাঁচাবাজারের গুটিকয়েক পণ্যের মধ্যে সীমিত থাকত। সবজির পাশাপাশি বেশ কিছু আমদানি পণ্যের দামও বেড়েছে, যার সঙ্গে বন্যার কোনো সম্পর্ক নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়লেও একশ্রেণির ব্যবসায়ী এটিকে মুনাফা লাভের মওকা হিসেবে নেন।
নিত্যপণ্যের দাম বাড়ার কারণ হিসেবে অতিবৃষ্টি ও বেহাল সড়ক যোগাযোগব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। এর কিছুটা বাস্তবতা নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু যেসব পণ্য বন্যাকবলিত এলাকার বাইরে উৎপন্ন হয় কিংবা বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, বন্যার অজুহাতে সেসব পণ্যের দাম বাড়ানোর কী যুক্তি থাকতে পারে? কয়েক দিন আগেও বাজারে যে কাঁচা মরিচ প্রতি কেজি ৬০ টাকায় বিক্রি হতো, সেই কাঁচা মরিচ ১৬০ টাকায় বিক্রি হওয়াকে কোনোভাবে স্বাভাবিক বলা যায় না। একই কথা প্রযোজ্য শসার ক্ষেত্রেও। বন্যার আগে প্রতি কেজি শসা বিক্রি হতো ৫০ টাকায়, এখন বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়।
বন্যার দোহাই দিয়ে আরও যেসব সবজির দাম বাড়ানো হয়েছে তার মধ্যে আছে কাঁচা পেঁপে, কাঁচকলা, আলু, কুমড়া, বেগুন, ঝিঙে, টমেটো, কচুমুখি, পটোল, ঢ্যাঁড়স ইত্যাদি। এসব সবজি যে শুধু বন্যাদুর্গত এলাকায় জন্মে তা নয়, দেশজুড়েই এসব সবজি উৎপাদিত হয়। তা সত্ত্বেও ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। দেশের একটি অঞ্চলের বন্যা যেন সারা দেশে দাম বাড়ানোর একটি সুযোগ হিসেবে হাজির হয়েছে।
আমাদের বাজারব্যবস্থায় এক অদ্ভুত প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে। পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম ১০ শতাংশ বাড়লে খুচরা বাজারে সেটি ২০–৩০ শতাংশ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। আবার পাইকারি বাজারে যেসব পণ্যের দাম ২০ শতাংশ কমে, খুচরা বাজারে সেটি ১০ শতাংশও কমে না। অর্থাৎ দুই দিক থেকেই ক্রেতাসাধারণ ক্ষতিগ্রস্ত হন।
বাজেটে আমদানির ওপর বাড়তি শুল্ক ধার্য করায় চিনির দাম বেড়েছে জুন থেকেই। আর ডিমের দাম কয়েক মাস ধরেই চড়া। মাস কয়েক আগে এক ডজন ডিম ৭০-৭২ টাকায় বিক্রি হলেও এখন হচ্ছে ১১০-১২০ টাকায়। বাজারে চীনা রসুন ১৬০ টাকা, দেশি রসুন ১৩০ টাকা, চীনা আদা ১৪০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে, যা আগের সপ্তাহের চেয়ে কেজিপ্রতি প্রায় ২০ টাকা বেশি। ভোজ্যতেলের দামও লিটারপ্রতি তিন টাকা বাড়ানো হয়েছে। একই সঙ্গে বেড়েছে মুরগি, গরুর মাংস ও খাসির মাংসের দামও।
সামনে কোরবানির ঈদ। এ সময় আদা, রসুন, দারুচিনি, এলাচিসহ সব মসলার চাহিদা বাড়বে। এ সুযোগে যাতে ব্যবসায়ীরা ভোক্তাদের ওপর খড়্গহস্ত হতে না পারেন, সে বিষয়ে এখনই সরকারকে পদক্ষেপ নিতে হবে। বন্যার সঙ্গে আমদানি করা পণ্যের দামও কেন বাড়িয়ে দেওয়া হলো? শুধু বন্যার কারণে নয়, এবার বাজেটে বেশ কিছু পণ্যের আমদানি শুল্ক বাড়ানোয় বাজারে প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
নতুন ভ্যাটনীতির ফলেও বেশ কিছু পণ্যের দাম বাড়বে। আবার চালের দামে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও মোটা চালের দাম কমেনি, যা দরিদ্র ও সীমিত আয়ের মানুষ কিনে থাকেন। সরকারের দৃষ্টিটা বরাবর ওপরের দিকে। নিম্ন আয়ের মানুষের সুরক্ষার বিষয়ে তারা অনেকটাই উদাসীন।
অতিবৃষ্টি ও বন্যার কারণে যদি নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে থাকে, তাহলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পণ্যমূল্য কমে আসার কথা। কিন্তু একবার বেড়ে যাওয়া কোনো পণ্যের দাম ফের কমার উদাহরণ খুবই কম। এখন বাজারে সব পণ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারলে চড়া বাজার আরও চড়বে। আমাদের প্রায় নির্বাক বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও নিষ্ক্রিয় টিসিবির ঘুম ভাঙুক।