রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে লোকজনের ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার খবর আসছে। বিশেষত ঢাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপে নগরবাসীর মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের হিসাবে চলতি জুলাইয়ের প্রথম ১২ দিনে মোট ১ হাজার ৬৪৩ জন মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিকে ভর্তি হয়েছে। বেসরকারি হিসাবে এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) হিসাবে গত এপ্রিল থেকে এ পর্যন্ত ১১ ব্যক্তি ডেঙ্গুতে মারা গেছে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ গুরুতর রূপ নিতে পারে।
এই পরিস্থিতিতে যখন ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশা নিধনের জন্য বিশেষভাবে তৎপর হওয়া উচিত, তখন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরোল, ঢাকার উভয় সিটি করপোরেশন মশা নিধনের জন্য যে ওষুধ ব্যবহার করে আসছে, তা মানসম্পন্ন নয়। আইইডিসিআর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের মে মাস পর্যন্ত রাজধানীর ৮টি এলাকায় এডিস মশা নিয়ে গবেষণা-জরিপ চালিয়ে দেখতে পেয়েছিল, ঢাকা উত্তর ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ওসব এলাকায় ছিটানো ওষুধে মশা মরছে না। সেটা তারা উভয় সিটি করপোরেশনকে জানিয়েছিল, কিন্তু তারা মশা মারার ওষুধ পরিবর্তনের উদ্যোগ নেয়নি।
বৃহস্পতিবার প্রথম আলোয় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা গেল, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তাদের ব্যবহৃত ‘লিমিট লিকুইড ইনসেকটিসাইড’ নামের মশা মারার ওষুধটি এখন আর ব্যবহার করছে না। কারণ, এত দিন পর তারা জানতে পেরেছে, ‘বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় মানোত্তীর্ণ’ হয়নি। তারা ওই ওষুধ পরীক্ষা করিয়েছে তিন দফায়। প্রথম দফায় দেখা গেছে, মাত্র ২ শতাংশ মশা মরেছে, দ্বিতীয় দফায় ১৮ শতাংশ এবং তৃতীয় দফায় ৫০ শতাংশ। কোনো ওষুধে ৯০ শতাংশ মশা না মরলে সেটাকে মানোত্তীর্ণ বলা হয় না। তাহলে প্রশ্ন, যে ওষুধে মাত্র ২ শতাংশ মশা মরে, ডিএনসিসি তা কত দিন ধরে ব্যবহার করেছে? কেন তারা ওই ওষুধের ব্যবহার শুরু করার আগেই তা যথাযথভাবে পরীক্ষা করিয়ে তার গুণগত মান সম্পর্কে নিশ্চিত হয়নি? এত দিন পরে এসে ওই ওষুধ বাতিল করার পাশাপাশি সেটির সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান লিমিট অ্যাগ্রো প্রোডাক্ট লিমিটেডকে কালো তালিকাভুক্ত করার কারণ আসলে কী?
অদ্ভুত বিষয় হলো, ডিএনসিসি যে মশা মারার ওষুধ মানোত্তীর্ণ নয় বলে বাতিল করেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সেটির ব্যবহার অব্যাহত রেখেছে। তারা বলছে, ওষুধটির ব্যবহার শুরু করার আগে তারা তা আইইডিসিআর ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্ল্যান্ট প্রোটেকশন উইংয়ের মাধ্যমে পরীক্ষা করিয়েছে এবং তাদের বলা হয়েছে যে ওষুধটির মান ঠিক আছে। ডিএনসিসিও কিন্তু বলছে, তারাও ওষুধটি একই জায়গায় পরীক্ষা করিয়েছে। ওষুধ সরবরাহকারী কোম্পানি এক, ওষুধটিও এক, পরীক্ষাকারী প্রতিষ্ঠান দুটিও অভিন্ন; তাহলে দুই সিটি করপোরেশনের পাঠানো নমুনা পরীক্ষা করে দুই রকমের ফল পাওয়ার রহস্য কী হতে পারে? এখানে কোনো অনৈতিক যোগসাজশ কাজ করেছে কি না, সে বিষয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
মশা মারার ওষুধের মান কেমন, তা জানার আরেকটা উপায় ভুক্তভোগী নগরবাসীর কথা শোনা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের এমন অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায় যে তাদের এলাকায় মশার উপদ্রবে জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। মশা মারার ওষুধ কার্যকর হলে এ রকম হওয়ার কথা নয়, ডেঙ্গুর প্রকোপও এভাবে বেড়ে যেতে পারত না। উভয় সিটি করপোরেশনের চূড়ান্ত দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহি নগরবাসীর কাছে—এটা মনে রাখলেই অকার্যকর ওষুধ ছিটিয়ে মশা মারার লোকদেখানো অভিযানের প্রয়োজন হবে না। ডেঙ্গুর প্রকোপ মহামারির রূপ ধারণ করার আগেই মশা নিধনের সর্বাত্মক ফলপ্রসূ উদ্যোগ নিশ্চিত করুন।