বাংলাদেশের ৮ হাজার ৮৪৮ জন নাগরিক বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কারাগারে বা বন্দিশিবিরে আটক আছেন বলে সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন সংসদে যে তথ্য দিয়েছেন, তা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। আইনি সহায়তার অভাবে অনেকে বছরের পর বছর বিনা বিচারে আটক থাকতে বাধ্য হচ্ছেন, যাদের মধ্যে শিশু ও নারীও আছেন।
সরকারের হিসাব অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি আটক আছেন ভারতে—২ হাজার ৪৯ জন। এ ছাড়া আবুধাবিতে ১ হাজার ১৫৬, বাহরাইনে ৬৯৩, মালয়েশিয়ায় ৫৭২, সৌদি আরবে ৭৬৮, ওমানে ৪৪২, কুয়েতে ৩১৬ ও তুরস্কে ৩২৭ জন আটক আছেন। তবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্যে পুরো তথ্য উঠে এসেছে বলে মনে হয় না। ২০১৭ সালের নভেম্বরে তৎকালীন প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ১৫ হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিক বিদেশের কারাগারে আটক ছিলেন বলে জানিয়েছিলেন।
গত দুই বছরে এই সংখ্যা নাটকীয়ভাবে কমে আসার কারণ কী হতে পারে? সরকার যুক্তি দেখাতে পারে, তাদের কূটনৈতিক তৎপরতায় বিদেশে আটক বন্দীদের একাংশ মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু দেশি-বিদেশি সংবাদমাধ্যমে প্রায় প্রতিদিনই বিদেশের কারাগারে নতুন করে বাংলাদেশি নাগরিক আটকের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। সৌদি আরবে অবস্থান করা বাংলাদেশি শ্রমিকেরা আকামায় (কাজের অনুমতিপত্র) উল্লিখিত পেশা ও যে কোম্পানি বা মালিকের অধীনে কাজ করার জন্য নির্দিষ্ট করা আছে, সেখানে কাজ না করে অন্য স্থানে বা অন্য কোনো পেশায় কাজ করার কারণে সৌদি সরকার তাঁদের আটক করছে। অর্থাৎ তাঁদের অপরাধ গুরুতর নয়। এর আগে সৌদি সরকার একাধিকবার আকামা পরিবর্তনের সুযোগ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল। অতএব এ ধরনের বন্দীদের ছাড়িয়ে আনা কিংবা আকামা পরিবর্তনের কাজে সহায়তা করা কঠিন নয়।
অন্যদিকে ভারতের কারাগারে যাঁরা আটক আছেন, তাঁদের একাংশ গেছেন পাচার হয়ে। মানব পাচারকারীরা এসব হতভাগ্য মানুষকে ভারতের কোনো স্থানে বা অন্য দেশে পাচার করতে অভিন্ন রুট হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। এ অবস্থায় কেউ আটক হলে দুই দেশের সরকারের উচিত জরুরি ভিত্তিতে আইনি সহায়তা দেওয়া। কেননা, আটকের ঘটনাটি বিদেশের মাটিতে ঘটায় সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা ছাড়া তাঁদের মুক্ত করা যাবে না। কয়েক বছর আগে ভারতে একজন বাংলাদেশি খুনের আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হন। পরে জানা যায়, তিনি ওই ঘটনার সঙ্গে মোটেই জড়িত ছিলেন না, নামের বিভ্রান্তির কারণে তাঁকে আটক করা হয়েছিল। ঘটনাটি সংবাদমাধ্যমে আসায় ভারত সরকার তাঁকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে। ভারত বা অন্য কোনো দেশের কারাগারে যাঁরা বিনা অপরাধে আটক আছেন, তাঁদের ছাড়িয়ে আনতে সরকারকে উদ্যোগী ভূমিকা নিতে হবে। তবে কেউ বিদেশে গিয়ে গুরুতর অপরাধে জড়িয়ে পড়লে আইন নিজস্ব গতিতেই চলবে। একসময় বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের বেশ সুনাম ছিল। গুটিকয়েক ব্যক্তির কারণে সেই সুনাম নষ্ট করতে দেওয়া যায় না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বিদেশের কারাগারে আটক বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্যতম দায়িত্ব। কিন্তু সেই দায়িত্বটি তারা ঠিকমতো পালন করছে না বলেই জনমনে ধারণা আছে।
অতএব, বিদেশের কারাগারে আটক বন্দীদের ছাড়িয়ে আনতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট দেশে বাংলাদেশ মিশনগুলোর কাছে আরও টেকসই ও কার্যকর ভূমিকা প্রত্যাশিত। প্রয়োজনে বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি যেসব অসাধু সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান বিদেশে লোভনীয় চাকরি দেওয়ার নাম করে শত শত অসহায় মানুষের জীবনকে মারাত্মক হুমকিতে ফেলে দিচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।