শুধু রেকর্ডই নয়, অনেক কিছুই তছনছ করে দিলেন নরেন্দ্র মোদি। প্রথম কংগ্রেসবিরোধী নেতা হিসেবে মোদি পরপর দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রীর আসনে বসতে চলেছেন। সংসদীয় ভারতের ইতিহাসে এটা রেকর্ড। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকা সত্ত্বেও দ্বিতীয় পর্বে শাসক দলের আসনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াও রেকর্ড। বুথ–ফেরত সমীক্ষা যেসব সংশয় ও সন্দেহের জন্ম দিয়েছিল, খড়কুটোর মতো সব উড়ে গেছে। দুটো স্লোগান বিজেপি এবার জোরের সঙ্গে উচ্চারণ করেছে। ‘ফির একবার, মোদি সরকার’ এবং ‘আব কি বার, তিন শ পার’। দেশের মানুষ বিনা বাক্যে সেই দুই স্লোগানকে সত্য করে তুলেছে। বিশ্বাস রেখেছে নরেন্দ্র মোদির ওপর। রচনা করেছে নতুন ইতিহাস।
একেবারে শুরু থেকেই মানুষের মনে বিজেপি যে প্রশ্ন তুলে ধরেছিল, তা ছিল নেতৃত্বের। ‘মোদি বনাম কে?’ এই প্রশ্ন তারা জনতার সামনে রেখেছিল। বিরোধীরা এই প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি। প্রশ্নের জবাবে বিরোধী নেতারা ২০০৪ সালের ভোটকে উদাহরণ হিসেবে খাড়া করেছিলেন। সেবার বিজেপির প্রধানমন্ত্রিত্বের মুখ ছিলেন অটল বিহারি বাজপেয়ি, বিপক্ষ মুখহীন। জিতেছিল ইউপিএ। প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন মনমোহন সিং। কিন্তু এবার মোদি ছাড়া আর কাউকেই মানুষ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভাবতে পারেনি। তাঁর কঠোর নেতৃত্ব, দৃঢ়চেতা মনোভাব, ঠিক সময়ে ঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা এবং দেশের শত্রুদের শায়েস্তা করার হিম্মত অন্য কেউ দেখাতে পারেন, মানুষ তা বিশ্বাস করতে চায়নি। আর তা হয়নি বলেই সত্য হয়ে উঠেছে দ্বিতীয় স্লোগানটিও। বিজেপি তিন শ পার করেছে।
মোদিকে চ্যালেঞ্জ জানাতে বিরোধীরা সর্বত্র একজোট হতে পারেনি। এটা তাদের ব্যর্থতা। সবচেয়ে জোরালো জোট তৈরি হয়েছিল উত্তর প্রদেশে। সমাজবাদী ও বহুজন সমাজ হাতে হাত মিলিয়ে বিজেপিকে রুখতে নেমেছিল। কংগ্রেসকে তারা জোটে রাখেনি। মোদি নামের রসায়নকে এই রাজ্যে কিছুটা হলেও রুখেছে সমাজবাদী-বহুজন সমাজ ও রাষ্ট্রীয় লোকদলের জোটের পাটিগণিত। কিন্তু তা-ও যৎসামান্য। একইভাবে বিহার ও ঝাড়খন্ডেও বিজেপিকে রুখতে চূড়ান্ত ব্যর্থ কংগ্রেস, রাষ্ট্রীয় জনতা দল, ঝাড়খন্ড মুক্তি মোর্চা এবং ওই দুই রাজ্যের স্থানীয় ছোট দলগুলো। মোদির রসায়নের কাছে জোটের পাটিগণিতের নিঃশর্ত সমর্পণ গো–বলয়ের এই রাজ্যগুলোয় জ্বলজ্বল করছে। কংগ্রেসের ওপর ভরসা ছিল গো–বলয়ের অন্য চার রাজ্যেও। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও গুজরাট। কংগ্রেস নিজেও নিজের ক্ষমতার ওপর ভরসা রেখেছিল। এই চার রাজ্যের মোট ৯১ আসনের মধ্যে ২০১৪ সালে বিজেপি পেয়েছিল ৮৮টি আসন। গুজরাট ছাড়া বাকি রাজ্যগুলোয় ক্ষমতায় এসেও কী করল কংগ্রেস? এবারের ফল যেন গতবারের হুবহু জলছবি! কর্ণাটক দখলে নেওয়ার পর ভাবা হয়েছিল, গতবারের চেয়ে ভালো ফল হয়তো এবার দেখা যাবে। কিন্তু হলো তার বিপরীত। মহারাষ্ট্রেও এ এক নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। এভাবে ধরাশায়ী হওয়ার একটাই ব্যাখ্যা, মোদি ছাড়া আর কাউকে এই মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে ভারতবাসী রাজি নয়।
দেশের মানুষ মনে করেছে মোদির হাতে দেশ নিরাপদ এবং এটাই ছিল এই নির্বাচনের প্রধান বিচার্য বিষয়। প্রচারের প্রথম দিকে সরকারের সাফল্য কিছুটা প্রাধান্য পেলেও বালাকোট–পরবর্তী প্রচারে দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নই বড় হয়ে ওঠে। সেই প্রচারের তোড়ে কংগ্রেসসহ বিরোধীদের অন্যান্য ইস্যু আমল পায়নি। কৃষক সমস্যা, বেকারি, সামাজিক অসন্তোষ, রাফাল, দুর্নীতি এবং ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’ স্লোগান খড়কুটোর মতো উড়ে গেছে। নির্বাচনের মুখে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে ময়দানে নামিয়েও কংগ্রেস মুখ রক্ষা করতে পারেনি।
ভোটের এই ফল কংগ্রেসের পক্ষে আরও পীড়াদায়ক হতে চলেছে। আগামী এক মাসের মধ্যে কংগ্রেসকে চূড়ান্ত পরীক্ষায় নামতে হবে মধ্যপ্রদেশ ও কর্ণাটকে। এই দুই রাজ্য কংগ্রেসের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে বিজেপি এবার মরিয়া হয়ে উঠবে। মধ্যপ্রদেশে কংগ্রেস ক্ষমতায় রয়েছে এক সুতোর ব্যবধানে। বিরোধী বিজেপি ওই রাজ্যে ইতিমধ্যেই সরকার ফেলে দেওয়ার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছে। কর্ণাটকেও কংগ্রেস-জেডিএস সরকার টলোমলো। পতন ঘটাতে বিজেপি সেখানেও এবার চেষ্টার ত্রুটি রাখবে না।
কঠিন হতে চলেছে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আগামী দিনগুলোও। বিজেপি শেষ পর্যন্ত কতগুলো আসন জিতল, তার চেয়েও বড় হয়ে দাঁড়াচ্ছে দল হিসেবে গোটা রাজ্যে এই প্রথম বিজেপির পায়ের তলার মাটি শক্ত হওয়া। এই ফলের পর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির আরও বড় উত্থান স্রেফ সময়ের ব্যাপার। ২০২১ সালে রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন। রাজ্যে প্রচারে এসে নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, তৃণমূল কংগ্রেসের ৪০ জন বিধায়ক বিজেপিতে যোগ দিতে উৎসুক। এই ফলের পর সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। ডুবন্ত জাহাজে কেই–বা থাকতে চায়? এই ফলের পর রাজ্যে বিজেপির আন্দোলন যেভাবে বেড়ে যাবে, তার সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়াবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে।
উত্তর-পূর্ব ভারতের পাশাপাশি বিজেপি এবার বেশি নজর দিয়েছিল পশ্চিমবঙ্গ ও ওডিশায়। দুই রাজ্যেই তারা সফল। এবার বিজেপির নজর আরও দক্ষিণে প্রসারিত হবে। অন্ধ্র প্রদেশ, তেলেঙ্গানা, তামিলনাড়ু ও কেরালা জয় করা হবে তাদের আগামী দিনের লক্ষ্য।
ভারতের লোকসভার এই ফল বাংলাদেশের পক্ষেও গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় দফায় মোদির ক্ষমতা লাভ তিস্তা চুক্তি ত্বরান্বিত করে তোলার পক্ষে সহায়ক হয়ে উঠতে পারে। মমতার বিরোধিতার কারণেই মোদি তিস্তা চুক্তি সই করতে পারেননি। মমতার দুর্বল হওয়া এবং রাজ্যে বিজেপির উত্থান সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করে চুক্তির বাস্তবায়িত হওয়ার পথ মসৃণ করে তুলতে পারে। বাংলাদেশের পক্ষে সেটা হবে বড় স্বস্তিদায়ক। তবে অস্বস্তির বিষয় হয়ে দাঁড়াতে পারে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি ও তার রূপায়ণ এবং নাগরিকত্ব বিলে সংশোধনের উদ্যোগ।
নরেন্দ্র মোদি ও অমিত শাহ প্রচারের সময় বারবার বলেছেন, এই দুটি বিষয় তাঁরা আজ হোক, কাল হোক রূপায়ণ করবেনই। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কোন খাতে বইতে পারে, তা অবশ্যই আগামী দিনের আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে।
সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় : প্রথম আলোর নয়াদিল্লি প্রতিনিধি