বালিশের দাম নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে আবাসিক ভবনের বালিশ, চাদর ইত্যাদির যে দাম দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে দেশ গরম। একটা বালিশের দাম দেখানো হয়েছে ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা। আর টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলায় কৃষক পাকা ধানের খেতে মনের দুঃখে আগুন দিয়েছিলেন। তাঁর দুঃখের কারণ, ধানের মণ ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। প্রায় ১০ মণ ধান লাগে একটা বালিশ কিনতে।
১৩ মে ২০১৯ প্রথম আলোয় প্রকাশিত ‘দাম না পেয়ে পাকা ধানে আগুন দিলেন কৃষক’ খবরটিতেই বলা হচ্ছে, ধান কাটা শ্রমিকেরা ১ হাজার টাকা মজুরি চান। তার সঙ্গে খাওয়া। আর সেই খাওয়া হতে হবে শ্রমিকদের পছন্দ অনুসারে।
প্রথমে আসি বালিশ প্রসঙ্গে। প্রথম আলোয় ২৩ মে ২০১৯ প্রথম পৃষ্ঠার খবর, ‘রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: কেনাকাটায় অভিনব দুর্নীতি’। ৩০টি চাদর আনতে একটা ট্রাক ভাড়া করতে হয়েছে ৩০ হাজার টাকায়। আবার কম্বল বা লেপ আনার জন্য দরকার হয়েছে আরও ট্রাক, সেটার খরচ দেখানো হয়েছে আরও ৩০ হাজার টাকা। আবার প্রতিটি চাদর নিচ থেকে খাটে তোলার জন্য খরচ দেখানো হয়েছে ৯৩১ টাকা। একটা চাদর ঘরে নিতে খরচ দেড়-দুই মণ ধানের দাম। ও বাংলার বোকা কৃষক, তুমি দেড় মণ ধান বানাতে কত মাস ধরে তোমার জীবনের সমান দামি জমিতে কী আয়ুধ্বংসী পরিশ্রম করো, তার বদলে একটা চাদর নিচতলা থেকে দোতলা-তিনতলা পর্যন্ত পৌঁছিয়ে দিলেই তো সমপরিমাণ টাকা অর্জন করতে পারতে!
বালিশ কেলেঙ্কারি তদন্তে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটো কমিটি গঠন করেছে। একজন প্রকৌশলীকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমাদের জোর দাবি, শক্ত তদন্ত করা হোক, তদন্তের প্রেক্ষাপটে দোষী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া হোক।
একজন আমাকে বললেন, ভাই, আপনারা বালিশের দাম, চাদরের দাম জানেন। তাই আপনারা ফেসবুকে শোর তুলেছেন। কিন্তু এই চাদরের স্পেসিফিকেশনে যদি বলা হতো, কোয়ান্টাম চাদর, রেডিয়াম বালিশ, লিথিয়াম সোফা, তখন কী করতেন? আরেকজন বলছেন, আগের সরকারের আমলে যে লাখ টাকায় বালিশ কেনা হয়েছিল, তা তো বলছেন না।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প খুবই স্পর্শকাতর, সন্দেহ নেই। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় স্পর্শকাতরতা এর নিরাপত্তা বিষয়ে। পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে দুর্ঘটনা রাশিয়ায় চেরনোবিল হয়েছে, জাপানে ফুকুশিমার দাইচিতে হয়েছে, আমেরিকায় থ্রি মাইল আইল্যান্ডে হয়েছে। কাজেই এটার নিরাপত্তার ব্যাপারটিতেই গুরুত্ব দিতে হবে সবচেয়ে বেশি। যদিও পৃথিবী থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র আস্তে আস্তে কমিয়ে ফেলা হচ্ছে, বহু দেশ এখান থেকে সরে আসছে। নিরাপত্তার ঝুঁকি থেকেই যায়। কাজেই রূপপুর প্রকল্পকে ৫০০ ভাগ নিরাপদ করতে হবে। এই প্রশ্নে কোনো ছাড় নেই।
কিন্তু দুটো বড় করণীয় এখন আমাদের সামনে আপনা-আপনি এসে যাচ্ছে। একটা হলো, সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতি বন্ধ করার জন্য একটা আন্দোলন শুরু করা। শেখ হাসিনার সরকার এই মেয়াদে যদি এই ডাক দেয়, তাহলে তা খুবই একটা সময়োপযোগী উদ্যোগ হবে। দুই নম্বর প্রশ্ন হলো, কৃষি এবং কৃষককে বাঁচানো।
দুর্নীতি নিয়ে কথা উঠলেই আমি আকবর আলি খানের লেখা পরার্থপরতার অর্থনীতি বইটা বের করি। তাতে দুর্নীতির হাজার বছরের ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। দুই হাজার বছর আগে মনু বলেছেন, ‘প্রজাদের রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে রাজা যাঁদের নিয়োগ করেন, তাঁরাই ভণ্ডামি করে অন্যদের সম্পত্তি গ্রাস করে এবং রাজাকে এ ধরনের কর্মকর্তাদের হাত থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে হবে। রাজার দায়িত্ব হলো যেসব দুষ্ট লোক মামলার বিভিন্ন পক্ষ থেকে উৎকোচ গ্রহণ করে, তাদের নির্বাসনে পাঠিয়ে দেওয়া এবং তাদের সকল সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।’ সরকার মনুর এই পরামর্শ গ্রহণ করে দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে।
আকবর আলি খান নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ গুনার মিরডালের কথা বলেছেন। জানিয়েছেন, দুর্নীতির চার ধরনের ক্ষতির কথা।
১. দুর্নীতি রাষ্ট্রের সামষ্টিক অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে। রাজস্ব আয় কমে যায়।
২. দুর্নীতিগ্রস্ত সমাজে পরিবেশ ধ্বংস হয়। (এটা আমরা আমাদের দেশে দেখছি। ফারুক রূপায়ন টাওয়ার বা রানা প্লাজা দুর্ঘটনার মূলে আসলে দুর্নীতি)।
৩. দুর্নীতির ধকলটা যায় দরিদ্র শ্রেণির ওপর দিয়ে। ওপরের তলার মানুষ ঘুষ-দুর্নীতি করে পার পায়। স্টিমরোলারের নিচে পড়ে গরিব মানুষ। (এই ঘটনাও আমরা দেখছি আমাদের দেশে, এই মুহূর্তেই: ওই যে গরিব কৃষক ধানের দাম পাচ্ছেন না, তারও পেছনে আছে দুর্নীতি এবং বৈষম্য)।
৪. দুর্নীতি বিদেশি বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।
এবার ডেইলি স্টার-এর ২০১৭ সালের ১৯ জুনের একটা খবর, ‘বিশ্বব্যাংক জানায়, চার লেন সড়ক নির্মাণের মধ্যে রংপুর-হাটিকুমরুল মহাসড়কে প্রতি কিলোমিটারের জন্য ৬৬ লাখ ডলার, ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে ৭০ লাখ ডলার, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কে ১ কোটি ১৯ লাখ ডলার, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ২৫ লাখ ডলার খরচ নির্ধারিত হয়েছে।’
অন্যদিকে চার লেন সড়ক তৈরিতে ভারতে ১১ লাখ থেকে ১৩ লাখ ডলার ও চীনে ১৩ লাখ থেকে ১৬ লাখ ডলার খরচ হয়।
এই হিসাব অনুযায়ী, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়ককে চার লেনে উন্নীত করার খরচ ভারতের কিছু সড়কের তুলনায় প্রায় ১০ গুণ বেশি।
৩০টি চাদর বহনের জন্য যদি একটা ট্রাক লাগে, তাহলে সড়ক নির্মাণের খরচ যে বেশি হবে, তাতে সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই।
কিন্তু সবচেয়ে বিস্ময়কর খবর ছিল গ্যাস না থাকা সত্ত্বেও গ্যাস বিতরণ প্ল্যান্টের খবরটি। ১৭ এপ্রিল ২০১৯ প্রথম আলোর খবরটির শিরোনাম ছিল: ১২০০ কোটি টাকা গচ্চা।
‘খুলনা, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পাঁচ জেলায় গ্যাস সরবরাহের জন্য গত চারটি সরকার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে। কিন্তু ১৪ বছরেও ওই এলাকায় গ্যাস যায়নি। এখন গ্যাস সরবরাহের প্রকল্পই বাদ দেওয়া হয়েছে।’
সরকারের পর সরকার অর্থ বরাদ্দ দিয়ে গেছে। কিন্তু তারা জানে, এটা আসলে সম্ভব না। তবু কাজ আরম্ভ করলে শেষ তো করতে হবে।
টাকা এত সস্তা এ দেশে! কোনো জবাবদিহি নেই। শুধু আমাদের কৃষক, আমাদের শ্রমিক শ্রমের মূল্য পান না।
যেকোনো বিপর্যয় থেকেই একটা ভালো দিকও বের হয়ে আসে। এই যে ধান কাটার কিষান পাওয়া যাচ্ছে না, এটা কিন্তু অর্থনীতির একটা সচলতারও লক্ষণ। মানে মানুষের হাতে বিকল্প কাজ আছে। এক বছরে ১০ লাখ মানুষ কাজের সন্ধানে বিদেশ গেছে। এই দেশে প্রতিবছর জন্ম নেয় ২০ লাখ শিশু। তার মধ্যে ১০ লাখ বিদেশে গেলে কোনো পুরুষ শ্রমিক যে পাওয়া যাবে না, এটা তো সহজ অঙ্ক।
তাহলে আমাদের করণীয় কী? ১. কৃষিপণ্যের ন্যায্য মজুরি যাতে কৃষক পান, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া। ২. কৃষিক্ষেত্রকেও অটোমেটেড করা, যাতে শ্রমিক কম দরকার হয়। কলের লাঙল তো এসেই গেছে; ধান কাটা, মাড়াই, বীজ বপনের জন্যও এখন যন্ত্র ছাড়া আর উপায় কী?
এবং দরকার দুর্নীতি দমন, আর বিদেশে টাকা পাচার রোধ। ভবন নির্মাণে লোহার বদলে বাঁশ দিলে ভবন ভেঙে পড়বে। বেশির ভাগ সরকারি ভবন, স্কুল, কলেজ, ছাত্রাবাসের ভবনগুলো দেখবেন, ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে। সড়ক যেন দুই মাস পরেই ভেঙে না পড়ে, কাজটা যেন প্রথম শ্রেণির হয়! নকশা যেন ভালো হয়। ফ্লাইওভার বানানোর পর যেন না দেখি, এটা আমেরিকান নকশা, ডান দিক দিয়ে উঠতে হবে বা আদৌ এখানে ফ্লাইওভার দরকার ছিল না।
একটা খবরে দেখলাম, বলা হচ্ছে, বিএসটিআই বলছে একটা কোম্পানির হলুদের প্যাকেটে ছাই আছে, রং আছে, শুধু হলুদ ছিল না। সর্বনাশ। খাদ্যে ভেজাল, ওষুধে ভেজাল, শ্যাম্পুতে ভেজাল, দুধে ভেজালের মতো গণহননকারী অপরাধ তো ক্ষমাহীনভাবে দমন করতে পারতেই হবে।
বালিশের খবরটা একটা ওয়েকআপ কল, ঘুম থেকে জেগে ওঠার ডাক। কিন্তু যে ব্যক্তি জেগে জেগে ঘুমায়, তাকে কে জাগাবে?
আনিসুল হক: প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক ও সাহিত্যিক