একসময় প্রচুর গল্প-উপন্যাস পড়তাম। এগুলোর বিশাল অংশজুড়ে থাকত প্রেমপর্ব। নর-নারীর চারি চক্ষুর মিলন, প্রথম দেখাতেই প্রেম উথলে ওঠা, চিরকুট চালাচালি—এসব পড়েছি, শুনেছি, দেখেছি। তখন একটা শব্দের মুখোমুখি হতাম প্রায়ই—প্রত্যাখ্যান। অমুক অমুককে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রত্যাখ্যানের আঘাতে উদ্বন্ধনে আত্মহত্যা। অর্থাৎ প্রেমে সাড়া না পেয়ে বা প্রতারণার শিকার হয়ে মনের জ্বালা জুড়াতে গলায় দড়ি দেওয়া—এ ধরনের সংবাদ শিরোনাম চোখে পড়ত। হয়তো এখনো এসব হয়।
প্রত্যাখ্যান শব্দটি নতুনভাবে ঘুরেফিরে আসছে। তবে তার মাজেজা ভিন্ন। সাম্প্রতিক দুটি প্রত্যাখ্যানের কথা আমরা জানি। দুটিই ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে। একটি প্রতিবেদন ছিল তৈরি পোশাকশিল্পের কর্মীদের মজুরি কমে যাওয়া সম্পর্কে। তৈরি পোশাক খাতের মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ প্রতিবেদনটি ‘প্রত্যাখ্যান’ করেছিল। তাদের দাবি, পোশাকশিল্পের কর্মীদের মজুরি বেড়েছে, কমেনি।
দ্বিতীয় ঘটনাটি পানি ও পয়োনিষ্কাশন দেখভালের দায়িত্বে থাকা ওয়াসাকে নিয়ে।টিআইবির প্রতিবেদনে এর একটি ভয়াবহ ছবি তুলে ধরা হয়। নাগরিকেরা যে দূষিত পানি ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন, তার জন্য ওয়াসাকে দায়ী করা প্রতিবেদনটি ওয়াসা কর্তৃপক্ষ যথারীতি ‘প্রত্যাখ্যান’ করল। ওয়াসার এমডি দাবি করে বসলেন, তাঁদের পানি শতভাগ বিশুদ্ধ। পরে ব্যাখ্যা দিয়ে বললেন, উৎপাদন পর্যায়ে এটা নিরাপদ, তবে সঞ্চালন লাইনে সমস্যা আছে। কথা হলো, ওয়াসার পাইপের মালিক কে? কে বসায় এসব পাইপ? আমের এক দিক ভালো, আরেক দিক পচা হলে আমরা কি এটাকে ভালো ফল হিসেবে ক্রেতাকে গছিয়ে দেব? প্রশ্ন উঠেছে, উনি এত বছর ধরে এমডি থাকেন কী করে। গ্রামবাংলায় একটি প্রবচন আছে, ছাগল নাচে খুঁটির জোরে।
আমার জানামতে, টিআইবি ব্যক্তি পর্যায়ে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করে না। তাদের কাজ প্রতিষ্ঠান নিয়ে। তারা বিভিন্ন সময়ে তাদের গবেষণায় পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে, কোথায় কী দুর্নীতি হয়। কখনো শিক্ষা অধিদপ্তর, কখনো পুলিশ বিভাগ, কখনো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের তালিকায় শীর্ষ দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ঢিলটি মাটিতে পড়ার আগেই লুফে নিয়ে বলেছে—প্রত্যাখ্যান করলাম।
দুনিয়াজুড়ে নাগরিক সংগঠনগুলো ‘ওয়াচডগ’ বা ‘প্রেশার গ্রুপ’ হিসেবে কাজ করে। যে দেশে এ ধরনের সংগঠনের অস্তিত্ব ও কাজ বেশি, সে দেশ তত এগিয়ে। আমাদের দেশে কোনো সরকারি কর্তৃপক্ষ কস্মিনকালেও বলে না, ভুল করেছি। একটি উদাহরণ না দিয়ে পারছি না। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় পুলিশ গুলি চালাল। ঝরে গেল কয়েকটি তাজা প্রাণ। কর্তৃপক্ষ একটি প্রেসনোট দিল। যাঁরা এই প্রেসনোট মুসাবিদা করেছেন, তাঁরা আজ আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকলেও কাজে নেই। অথচ এ ধরনের সাম্প্রতিকতম ঘটনার প্রেসনোটেও আমরা দেখি অবিকল একই ভাষা, একই শব্দাবলি। এগুলো কি ভূতে লিখে দেয়? উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সামাল দিতে না পেরে আত্মরক্ষার্থে পুলিশ প্রথমে মৃদু লাঠিচার্জ, তারপর কাঁদানে গ্যাস এবং সবশেষে উপায়ান্তর না দেখে গুলি চালাতে বাধ্য হয়। এ ধরনের প্রেসনোট আমরা দেখি নিত্যদিন।
কয়েক বছর আগে আমাদের এক মন্ত্রী ব্রাজিল থেকে গম এনে খাইয়েছিলেন। নিন্দুকেরা বলেছিল, গম পচা। মন্ত্রী অস্বীকার করেছিলেন। সরকারের মেয়াদের শেষ দিন পর্যন্ত মন্ত্রী ছিলেন তিনি।
কিছুদিন আগে পুরান ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টায় বড়সড় একটা অগ্নিকাণ্ড হলো। সংবাদমাধ্যমের কল্যাণে আমরা জানতে পারলাম, ওখানে ব্যবসায়ীরা হরেক রকমের ‘দু-নম্বরি মাল’ তৈরি করত। আমাদের সরকার তো ব্যবসাবান্ধব। আদতে ব্যবসায়ীবান্ধব। সরকার তদন্ত কমিটি তৈরি করল। তদন্ত কমিটি কাজ শুরু করতে না করতেই শিল্পমন্ত্রী বলে বসলেন, আগুনের সূত্রপাত নাকি রাস্তার পাশে গ্যাস সিলিন্ডার থেকে। পরে জানা গেল, আগুন প্রথমে লেগেছে ওই ভবনের দোতলায়। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছে করে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন—এ অভিযোগ কিন্তু কেউ করেনি। অভিযোগ ছিল, তাঁদের গুদামের দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। প্রশ্ন উঠেছিল, ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকায় দাহ্য পদার্থের ব্যবসা বন্ধ হচ্ছে না কেন? শিল্পমন্ত্রী খামোখা এতে নিজেকে জড়ালেন। এর কোনো প্রয়োজন ছিল না।
আমাদের শাসকদের সমালোচনা সহ্য করার মানসিকতা নেই। এটা আজ নতুন নয়। এই প্রবণতা শুরু থেকেই। সমালোচকদের উদ্দেশে পেয়ারা পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান হুংকার দিয়ে বলেছিলেন, ‘শের কুচাল দেঙ্গে’। অর্থাৎ মাথা কেটে ফেলব। এখন শব্দটা একটু বদল হয়েছে। মাঝে বলা হতো, ‘বরদাশত করা হবে না।’ এখন তা ‘প্রত্যাখ্যানে’ এসে ঠেকেছে।
যাঁরা সংবাদমাধ্যমে কাজ করেন, তাঁদের অভিযোগ ও আশঙ্কা, অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার সুযোগ ও পরিবেশ নেই। এ নিয়ে তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ আছে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না দায়বদ্ধতার কারণেই তাঁদের সত্য কথাটি বলতে হয়। কেননা, এর একটি সামাজিক চাহিদা আছে। আমাদের আশপাশে আমরা প্রতিদিনই কিছু না কিছু ভুল, অসংগতি ও অপরাধ হতে দেখছি। অপরাধীদের ছাড়া পেতে এবং প্রকাশ্যে বুক চিতিয়ে হাঁটতেও দেখি। আমরা চাই এই তথ্যগুলো সবাই জানুক, এসব প্রতিরোধ করার জন্য জনসচেতনতা তৈরি হোক। সংবাদমাধ্যমের কাজ হলো সমাজের চাহিদা অনুযায়ী তথ্যের জোগান দেওয়া। সে কাজটিই তাঁরা করবেন পেশাদারির সঙ্গে। সেখানেও বাধা। সব জায়গায় সরকার বাগড়া দেয়।
বেশ কয়েক বছর আগে অধ্যাপক রেহমান সোবহান কিছু কলাম লিখেছিলেন। শিরোনাম ছিল, ‘আমার সমালোচক আমার বন্ধু’। কিন্তু সবাই যেন এর উল্টো বুঝতেই অভ্যস্ত। অর্থাৎ ‘আমার সমালোচক আমার শত্রু’। অধ্যাপক রেহমান সোবহানের মতো ব্যক্তিত্বকে নিয়েও বিভিন্ন সময়ে সরকারি দলের কিছু নেতা অসৌজন্যমূলক মন্তব্য করেছেন। তাঁরা ভুলে গেছেন, অথবা তাঁরা হয়তো জানেন না, ‘পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নামটিতে ‘পিপল’ শব্দটি যোগ করেছিলেন তিনি। এটা একাত্তরের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহের কথা। আমাদের নেতারা এসব জানার তাগিদ অনুভব করেন না। ‘জিন্দাবাদ’ শুনতেই তাঁরা অভ্যস্ত। এ দেশটা কীভাবে জন্ম নিয়েছে, তা নিয়ে তাঁদের মাথাব্যথা নেই। দেশের দখলদারি নিয়েই তাঁরা খুশি।
সরকারের মনোরঞ্জন করে তো সংবাদমাধ্যম চলে না। তাহলে দলীয় পত্রিকাগুলোই হতো সবচেয়ে জনপ্রিয়। দলীয় পত্রিকা দলের লোকেরাই পড়ে না। বাংলার বাণী বন্ধ হয়ে গেছে। দিনকাল চলছে টিমটিম করে। সরকারের মাউথপিস অনেক সংবাদমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে কর্মীরা মাসের পর মাস বেতন পান না। এসব খবর তো চাপা থাকে না। আমাদের দেশের পাঠক পত্রিকায় সরকারি সংস্থার দেওয়া ক্রোড়পত্র পড়ে না। এগুলো হলো নিজের ঢোল নিজে বাজানোর বিজ্ঞাপন। বিজ্ঞাপন পড়ে কয়জন? মানুষ যা পড়তে চায়, শুনতে চায়, তার বিপরীত স্রোতে গিয়ে বেশি দিন কি টেকা যাবে?
পাকিস্তানের একসময়ের তথ্যসচিব আলতাফ গওহরের আগ্রহে ও পরামর্শে পাকিস্তানের ‘লৌহমানব’ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ‘উন্নয়ন দশক ১৯৫৮-৬৮’ দেশজুড়ে ঘটা করে উদ্যাপন করা হয়েছিল। তিন মাসের মাথায় তাঁকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়েছিল। তারপরও দেশে পরামর্শদাতা চাণক্যের ঘাটতি দেখি না। কামরুদ্দীন আহমদের লেখায় পড়েছিলাম, ‘কথায় বলে, যারা রাজনীতি করে তারা ইতিহাস সৃষ্টি করে। তারা ইতিহাস পড়ে না, তাই ইতিহাস থেকে কোনো শিক্ষা পায় না।’ প্রশ্ন হলো, কজন রাজনীতিবিদ বা সিদ্ধান্ত প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ কামরুদ্দীন আহমদের নাম শুনেছেন? তাঁর লেখা পড়েছেন?
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক