দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠিত হয় ২০০৪ সালে একটি আইনের মাধ্যমে। এর পূর্বসূরি প্রতিষ্ঠান দুর্নীতি দমন ব্যুরো অকার্যকর প্রতিপন্ন হওয়ায় বিলুপ্ত হয়। দুদক প্রতিষ্ঠিত হলেও প্রথম দুই বছর একরকম নিষ্ক্রিয়ই ছিল। ২০০৭ সালে এক–এগারোর পর জরুরি ক্ষমতা আইনের প্রত্যক্ষ সমর্থনে প্রতিষ্ঠানটি হয় অতি সক্রিয়। ২০০৯–এর সূচনায় নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে অনেকটা ঝিমিয়ে পড়ে। বছর তিনেক আগে একে কিছুটা সক্রিয় হতে দেখা যায়। তবে জনগণের প্রত্যাশার সঙ্গে রয়েছে অনেক ফারাক। এর সক্রিয়তার ব্যারোমিটার ক্রমের ওঠানামা লক্ষণীয়। এমনকি প্রতিষ্ঠানটি রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত, এমনটাও সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়নি। অথচ তা করার আইনের সুযোগ তাদের রয়েছে।
অবশ্য এ ধরনের বিধান থাকা সত্ত্বেও আমাদের সাংবিধানিক ও আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত অনেক প্রতিষ্ঠানকেই সরকারের মুখাপেক্ষী থাকতে দেখা যাচ্ছে। স্বকীয় সত্তা তুলে ধরার ইচ্ছা বা সুযোগ তাদের আছে কি না, তা দুর্বোধ্য। যাহোক, দুর্নীতি আমাদের সমাজের একটি বড় ব্যাধি। এর লাগাম টেনে ধরতে পারলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি আরও বাড়বে, এটা ব্যাপকভাবে ধারণা করা হয়। আর তা করা দুদকের একক কাজও নয়। তবে দুর্নীতির ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিদের আইনের আওতায় এনে সাজার ব্যবস্থা করার মূল দায়িত্ব তাদের। দুর্নীতি করলে সাজা ভোগ করতে হয় এটা যত বেশি প্রমাণিত হবে, তত বেশি সচেতন হবে সমাজ। আর এ কার্যক্রম যদি চলে দলমতের ঊর্ধ্বে সবার জন্য, তখন অধিকতর গ্রহণযোগ্যতা পাবে এটা। এসব দায়িত্ব পরিচালনার জন্য দুদককে বেশ কিছু ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। সময়ের আবর্তনে দেখতে হয় সে ক্ষমতা পর্যাপ্ত কি না? পাশাপাশি দেখা আবশ্যক, অপব্যবহার হচ্ছে কি না এ ক্ষমতার। এসব দেখেই সে ক্ষমতা কাঠামোয় আনা হয় পরিবর্তন।
তেমন কিছু পরিবর্তনের দাবি এসেছে দুদকের পক্ষ থেকে। তারা প্রথমে নিজস্ব পুলিশ চেয়েছে। দেওয়া হয়নি। পুলিশ বাহিনীর কিছু সদস্যকে দুদকের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়েছে। এটা একটি মনস্তাত্ত্বিক দিক। দুদক দুর্নীতিবিরোধী বিভিন্ন কাজ চালায়। এটা করতে তাদের কর্মকর্তাদের যথেষ্ট নিরাপত্তা বিধানের আবশ্যকতা রয়েছে। অভিযোগ অনুসন্ধান, তদন্ত ও অভিযোগপত্র দাখিলের পুলিশি ক্ষমতা তো দুদক আইনে দুদক কর্মকর্তাদেরই। প্রয়োজন অভিযান বা আসামি গ্রেপ্তারকালে নিরাপত্তা। এর জন্য পুলিশ নামে কিংবা ভিন্ন কোনো নামে ছোটখাটো একটি বাহিনী হতে পারত। যেমনটা আছে বনরক্ষী, কারারক্ষী ইত্যাদি। সব কাজের জন্য বৃহৎ কলেবরে একটি একক পুলিশ বাহিনী রাখার দিকটি নতুনভাবে ভেবে দেখার আবশ্যকতা রয়েছে।
যাহোক, দুদকের এ প্রস্তাবে সময়ান্তরে পুনর্বিবেচনা আবশ্যক হতে পারে। দুদক চায়, থানায় না হয়ে তাদের দপ্তরে মামলা হবে। এজাহার ও অভিযোগপত্র সরাসরি যাবে আদালতে। আর দুদক আইনে গ্রেপ্তারকৃত আসামিদের আদালতে সোপর্দের আগ পর্যন্ত রাখা হবে দুদকের নিজস্ব হাজতখানায়। প্রতিষ্ঠানটির যদি নিজস্ব অবকাঠামো থাকে, তাতে এরূপ ব্যবস্থায় দোষের কিছু দেখা যায় না। তবে দেশের সর্বত্র অনেক টাকা ব্যয় করে নতুন নতুন অবকাঠামো করা এর জন্য অত্যাবশ্যক নয়। তদুপরি এদের প্রহরাসহ খাদ্য, পানি ইত্যাদি সরবরাহের জটিল ব্যবস্থাটিও এর সঙ্গে প্রাসঙ্গিক। তাই ক্ষেত্রবিশেষে থানায় আসামি রাখা হলেও দোষের কিছু নেই। আর দুদক আইনের মামলার যথাযথ নজরদারির জন্য তাদের কার্যালয়ে দায়ের থেকে অভিযোগপত্র প্রেরণেও কারও আপত্তি থাকার কথা নয়। এজাহার ও অভিযোগপত্র এখন থানার মাধ্যমে পাঠানো হলেও দুদক কর্মকর্তারাই তা করছেন।
দুদক যেসব বিষয় সংশোধনের দাবি করেছে, তার মধ্যে মূলত দুটো বিষয় নিয়ে কোনো কোনো মহল ভিন্নমত দিচ্ছে। তা আসতেই পারে। দুদক চায় আয়কর রিটার্ন ও ব্যাংক হিসাব তলবের ক্ষমতা। তাদের মতে, দুর্নীতি কার্যকরভাবে দমনের লক্ষ্যেই এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পক্ষান্তরে শিল্প ও বণিক সমিতির পক্ষ থেকে সরাসরি এ ধরনের ক্ষমতা দেওয়ার বিপক্ষে বক্তব্য এসেছে। তাদের মতে, এরূপ ক্ষমতা দেওয়া হলে শঙ্কা বাড়বে। অন্যদিকে আয়কর কর্মকর্তাদের একটি সংগঠনের মতে, এমনটা করা হলে আয়কর আদেশ প্রতিপালন ও রাজস্ব আদায়ে বিরূপ প্রভাব পড়বে। কেউবা বলছেন, প্রস্তাবিত বিধান অর্থ পাচার বাড়াবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত হবে ব্যাংকিং খাত। এখানে ব্যাংকার্স বুক অব অ্যাভিডেন্স অ্যাক্ট, ১৮৯১ এবং আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৬১–এর কথাও বলা হচ্ছে। প্রথমত, আইনটি ব্যাংকে গচ্ছিত কারও টাকার হিসাব আদালতের আদেশ ব্যতিরেকে অন্যকে না দেওয়ার ব্যাপারে একটি কঠোর অবস্থান রয়েছে।
যে সময় আইনটি তৈরি তার প্রেক্ষাপটে এটা যৌক্তিকই ছিল। কিন্তু সময় পাল্টেছে। অতি সম্প্রতি প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একটি বেসরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের ব্যাংক হিসাবে ৩৫ কোটি টাকা রয়েছে। এ টাকা তাঁর আয়কর বিবরণীর সঙ্গে সংগতিহীন। তখন কি দুদক এ তথ্য চাইলে অযৌক্তিক বলা যাবে? এমন শত শত ক্ষেত্র রয়েছে। তদুপরি ব্যাংকের আইনে যা–ই থাকুক, ১৯৬১ সালের আয়কর অধ্যাদেশের একজন আয়কর কমিশনার যেকোনো ব্যক্তির হিসাব তলব করতে পারেন। এটাও যৌক্তিক। আজকের সমাজে দুর্নীতির ব্যাপকতা ও দুদকের ভূমিকাকে বিবেচনায় নিলে এ ধরনের ক্ষমতায়নকে অযৌক্তিক বলা যাবে না। বরং বলা যেতে পারে, ঢালাও হতে পারবে না এ ধরনের ক্ষমতার প্রয়োগ। এনবিআরের পক্ষ থেকে বলা হয়, এ দেশের শতকরা একজন মানুষ আয়কর দেয়। তখন আয়কর আইনের ব্যাপক প্রয়োগ তারা করতে পেরেছে, এমন দাবি করা যাবে না। অবশ্য এক দশক আগের তুলনায় সেটা যে বহুগুণ বেড়েছে, তা তাদেরই চেষ্টায়, এটাও অস্বীকার করা যাবে না। দুদকের এ ধরনের ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও দেশ থেকে টাকা পাচার বন্ধ হয়েছে কিংবা ব্যাংক খাতে কোনো সংকট নেই, এমন দাবিও করা যাবে না। তবে দুদকের প্রস্তাবিত ক্ষমতায়নে এত শঙ্কা কিসের?
দুদক কোনো ধন্বন্তরি প্রতিষ্ঠান, এমন নয়। এ সমাজে এর অস্বিত্ব প্রকট না হলেও উপেক্ষণীয় নয়। প্রতিষ্ঠানটিকে ক্রমান্বয়ে সজীব ও কার্যকর করা দরকার। ব্যাংক হিসাব ও আয়কর বিবরণীর তলব নিয়েই গেল গেল রব ওঠার কোনো কারণ দেখ যাচ্ছে না। তথ্য অধিকার আইনের তফসিলে সুনির্দিষ্টভাবে সংরক্ষিত বলে এগুলোর উল্লেখ নেই। শুধু কারও ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষার কথা বলা আছে। আর সে ‘ব্যক্তিগত’ বিষয়টির সংজ্ঞাকে বিশাল ক্যানভাসে নেওয়া যাবে না। তেমনি দুদক কর্মকর্তাদেরও দেওয়া যাবে না এগুলো নিয়ে যেনতেনভাবে টানাহেঁচড়ার অধিকার। আইন যত কঠিন হবে, অভিযুক্তের সুরক্ষাও তত সবল হতে হবে। ব্যাংক হিসাব ও আয়কর বিবরণী অবশ্যই অনেকটা ব্যক্তিগত বিষয়। যৌক্তিক সন্দেহভাজন না হলে কারও তথ্যাদি নিয়ে টানাহেঁচড়া করা অসংগত হবে। প্রাথমিক তথ্যাদি পাওয়ার পর দুদকের যেকোনো একজন কমিশনারের অনুমোদন নিয়ে মহাপরিচালক পর্যায় থেকে এটা তলবের ক্ষমতা দেওয়া যায়। যেমন ব্যবস্থা আছে ফাঁদ পাতা মামলার ক্ষেত্রে।
দুদকের অভ্যন্তরে শুধু সজ্জনেরা আছেন আর অন্যত্র দুর্নীতিবাজেরা, এমনটা মোটেই নয়। দুদকের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলাও তেমন মজবুত কাঠামোর ওপর দাঁড়ায়নি এখনো। তা সত্ত্বেও দুর্নীতি দমন কার্যক্রমের জন্য দেশে আইন দ্বারা গঠিত ও ক্ষমতাপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান একটাই। তার কার্যক্রম সুচারুভাবে পরিচালনার জন্য যদি কোনো আইন বা বিধির কিছু সংশোধন বা সংযোজন আবশ্যক হয়, তবে সেটাকে যৌক্তিকভাবে বিবেচনা করা সংগত। অন্য ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটে চলেছে নিয়ত।
আলী ইমাম মজুমদার: সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব
[email protected]