প্রতিদিন পত্রিকায় এত দুঃসংবাদ থাকে যে দু-একটি আশাজাগানিয়া খবরই আমাদের দৃষ্টি কেড়ে নেয়। এ রকম একটি খবর হলো ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া কৃষকদের পাশে দাঁড়িয়েছেন শিক্ষার্থীরা। কৃষক যাতে ন্যায্য দাম পান, সে জন্য তাঁরা আন্দোলন করছেন। খেতের ধান কেটে দিয়ে কৃষককে সহায়তা করছেন।
গতকাল প্রথম আলোর প্রথম পাতায় প্রকাশিত মিসবাহ উদ্দিনের ছবিতে দেখা যায়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সিলেটের এক কৃষকের খেতের ধান কাটার কাজে সহায়তা করছেন। এর আগে টাঙ্গাইলের বিভিন্ন কলেজের ১৫ জন শিক্ষার্থী এক কৃষকের ধান কেটে দিয়েছেন, যিনি মজুরের অভাবে ধান কাটতে পারছিলেন না। এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষক পান ৫০০ টাকা। আর একজন মজুরকে দিনে দিতে হয় ৮৫০ টাকা। ফলে অনেক কৃষকই মজুর লাগাতে পারছেন না।
গত সোমবার কোটা আন্দোলনখ্যাত সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের নেতা-কর্মীরা ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাজপথে ধান ছড়িয়ে ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার প্রতিবাদ করেছেন। জাতীয় প্রেসক্লাব ও রাজু ভাস্কর্যের সামনে মানববন্ধনও করেছেন তাঁরা, যার নেতৃত্ব দিয়েছেন ডাকসুর ভিপি নুরুল হক। দেশের আরও অনেক স্থানে ছাত্ররা কৃষকদের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছেন।
তরুণ প্রজন্ম সম্পর্কে অনেকের অভিযোগ যে তাঁরা নিজেদের স্বার্থের বাইরে কিছু বোঝেন না। দেশ-জাতির কথা ভাবেন না। সারাক্ষণ ফেসবুক-মোবাইল-ইন্টারনেট নিয়ে থাকেন। গত বছর সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা যখন কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছিলেন, তখনো বলা হয়েছিল, তাঁরা তো নিজেদের চাকরির জন্য মাঠে নেমেছেন।
কিন্তু আজ তরুণেরা ধানের ন্যায্যমূল্যের দাবিতে রাজপথে কর্মসূচি পালন করে কিংবা মাঠের ধান কাটতে কৃষককে সহায়তা করে প্রমাণ করলেন, তাঁরাও সুখে-দুঃখে গণমানুষের পাশে দাঁড়াতে দ্বিধা করেন না। তরুণেরা যে কখনো ভুল করেন না, তার প্রমাণ আমরা ভাষা আন্দোলনে পেয়েছি, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানে পেয়েছি, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে পেয়েছি। সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচনেও তাঁরা প্রমাণ করেছেন এবং পুরো না হলেও আংশিক সফল হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অনিয়ম–দুর্নীতিকে প্রশ্রয় না দিলে ৪৪ হাজার শিক্ষার্থী দেখিয়ে দিতেন ‘ভোটবিপ্লব’ কাকে বলে।
বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ মানববন্ধন করে ধানসহ সব কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য নির্ধারণ, কৃষি খাতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি প্রদান ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য কমিয়ে আনার দাবিতে। মানববন্ধনে অংশ নিয়ে ডাকসুর ভিপি নুরুল হক বলেন, ‘যে দেশের অর্থনীতি কৃষির ওপর দাঁড়িয়ে আছে, সে দেশের কৃষকেরা ধানের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না। খুলনায় পাটকলশ্রমিকেরা বকেয়া মজুরির দাবিতে আন্দোলন করছেন। সেখানে সরকার বাধা দিয়েছে। কোনো শ্রমিক সংগঠন বা সরকার তাঁদের পাশে দাঁড়ায়নি।
রাজনৈতিক দলগুলো সাধারণ মানুষের পালস (মনোভাব) বোঝে না। আমরা কৃষকসহ সব শ্রমিক, মেহনতি মানুষের পাশে আছি।’ ডাকসুর সমাজসেবা সম্পাদক আখতার হোসেন বলেন, ‘আমি ছাত্র, আমি কৃষক পরিবারের সন্তান। এক মণ ধানের দাম ৪৫০-৫০০ টাকা। এই ধান থেকে চাল হয় ১ হাজার ২০০ টাকার। ৭০০ টাকা তারা খেয়ে ফেলছে। সিন্ডিকেট এই টাকা মেরে দিচ্ছে। কৃষকের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার দায় রাষ্ট্রের।’
সাধারণ ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের সদস্যরা দেশের ১৬টি স্থানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেছে। প্রতিবাদ হয়েছে টাঙ্গাইল, ভোলা, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ ও নারায়ণগঞ্জে। দাম কম হওয়ায় জয়পুরহাটে ধানে আগুন দিয়ে প্রতিবাদ করেছে খেতমজুর সমিতি।
ছাত্রলীগ ও সাধারণ ছাত্র পরিষদ—দুটিই ডাকসুতে প্রতিনিধিত্ব করে। অথচ তাদের চরিত্র ও আচরণে কত ফারাক। ছাত্রলীগের নেতারা সাধারণ শিক্ষার্থী বা কৃষকের বঞ্চনা সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি।
সাধারণ ছাত্র পরিষদের নেতা-কর্মীরা যখন কৃষকদের অধিকারের দাবিতে ক্যাম্পাসে আন্দোলন করছেন, তখন সরকার-সমর্থক ছাত্রসংগঠনটি অন্তঃকলহে লিপ্ত। ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধের জের ধরে এক পক্ষ অপর পক্ষের ওপর হামলে পড়েছে। চেয়ার ছুড়ে মেরে নারী কর্মীদের হাসপাতালে পাঠিয়েছে। এ ছাড়া পদবঞ্চিতরা ছাত্রলীগের নতুন কমিটির নেতাদের ডোপ টেস্ট করার দাবি জানিয়েছেন। কেউ মাদক সেবন করেন কি না, সেটি পরীক্ষা করতেই ডোপ টেস্ট করা হয়।
কৃষকের দুরবস্থায় সরকার নির্বিকার থাকলেও আওয়ামী লীগের অন্তত দুজন নেতা তাঁদের পক্ষে কথা বলেছেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও খাদ্য মন্ত্রণালয়–সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ নাসিম ভর্তুকি দিয়ে হলেও কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করতে বলেছেন। আর জাতীয় সংসদের হুইপ আবু সাঈদ আল মাহমুদ খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের উদ্দেশে তাঁর ফেসবুক পেজে লিখেছেন, ‘আপনি কৃষকের সঙ্গে মশকরা করতে পারেন না।’
রোববার টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলার কৃষক আবদুল মালেক সিকদার ধানের দাম না পেয়ে তাঁর ধানি জমিতে পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেন। সংবাদমাধ্যমে এই খবর ও ছবি প্রকাশের পর তা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বুধবার সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলায় ধান ও চাল ক্রয় উদ্বোধন শেষে খাদ্যমন্ত্রী ওই ঘটনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘ধানের দাম ২০০ টাকা মণ হলেও একজন কৃষক কখনো ধান পোড়ানোর মতো কাজ করবেন না। এটি একটি মহলের পরিকল্পিত ঘটনা, যাতে সরকারকে বিপর্যস্ত অবস্থায় ফেলা যায়।’
খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্যের জবাবে ফেসবুক পেজে আবু সাঈদ আল মাহমুদ লিখেছেন, ‘একজন অসহায় কৃষকের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকেও সহ্য করতে পারবেন না? আপনি তো সামরিক স্বৈরাচারের মন্ত্রী নন। আপনাকে স্মরণ রাখতে হবে, আপনি আমলা বা ব্যবসায়ী কোটার মন্ত্রী নন। তৃণমূল থেকে কাদামাটি গায়ে মাখা রাজনীতিবিদ। ইউনিয়ন চেয়ারম্যান থেকে ধাপে ধাপে ধান আবাদি মানুষের সহযোগিতা–সমর্থনে আজকের পর্যায়ে এসেছেন। অন্তত আপনি কৃষকের সঙ্গে মশকরা করতে পারেন না। আপনি, আমি কৃষকের ভোটে, কৃষকের দয়ায় সংসদে এসেছি। কৃষককে ধানের মূল্য দিতে পারবেন না, বিনয়ের সঙ্গে সম্মানিত কৃষকদের সীমাবদ্ধতার কথা অবহিত করুন। সমস্যা কোথায়? অসীম সমস্যার এই দেশে সবকিছু রাতারাতি ঠিক হবে না, এ কথা বিনয়ের সঙ্গে বললে মানুষ গ্রহণ করবে।’ (সূত্র: যুগান্তর, ১৬ মে, ২০১৯)
মন্ত্রীকে এমন শক্ত ভাষায় বিরোধী দলের কোনো নেতা বা কোনো সাংবাদিক সমালোচনা করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে হয়তো তাঁর বিরুদ্ধে মামলা হতো।
কৃষকের ধানের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ার জন্য সরকারের ভুল নীতিই দায়ী। প্রথমত, সরকার ধান-চাল কেনার ঘোষণা দিলেও কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি কিনছে না। কিনছে চালকলের মালিকদের কাছ থেকে। চালকলের মালিকেরা বলছেন, বাজারে চালের দাম কম থাকায় গত বছরের প্রচুর ধান গুদামে পড়ে আছে (কোনো কোনো সূত্র বলেছে ৪২ লাখ টন)। গত বছর ধানের বাম্পার ফলন হলেও আমদানি শুল্ক আরোপ করা হলো অনেক দিন পর, গত নভেম্বরে। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ীদেরই সুবিধা করে দেওয়া হয়েছে।
বাজারে এখন ধানের দাম মণপ্রতি ৫০০ টাকা। সরকার ১০ লাখ টন চাল, দেড় লাখ টন আতপ চাল ও দেড় লাখ টন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চালের দাম ধরা হয়েছে কেজিপ্রতি ৩৬ টাকা। ধান ২৬ টাকা। অথচ কৃষকের এক কেজি ধান উৎপাদন করতেই ৩৬ টাক খরচ পড়ে। এ অবস্থায় কৃষকের লোকসান ঠেকানোর উপায় নেই। নিরুপায় হয়েই কৃষকেরা প্রতিবাদ করছেন।
এভাবে কৃষকের পাশে তরুণদের দাঁড়ানো বাংলাদেশের ইতিহাসে ব্যতিক্রম না হলেও বিরল ঘটনা। যে তরুণেরা কৃষকের পাশে দাঁড়িয়েছেন, তাঁদের অভিনন্দন জানাই। আর সরকারকে বলছি, দেরিতে হলেও কৃষকের দিকে দৃষ্টি দিন। কৃষক বাঁচলেই দেশ বাঁচবে।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
[email protected]