ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহমেদ খান বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সদ্য বিদায়ী মহাপরিচালক। প্রথম আলোর সঙ্গে তিনি কথা বলেছেন বাংলাদেশের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা, ঝুঁকি ও করণীয় নিয়ে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান
প্রথম আলো: সামগ্রিকভাবে দেশের অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা কতটা দুর্বল বা শক্তশালী? এত দুর্ঘটনার কারণ কী?
আলী আহমেদ খান: অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। একটি আধুনিক শহরে হাইড্রেন্ট সিস্টেম থাকে, যেখান থেকে দ্রুত পানি টেনে নেভানোর কাজে লাগানো যায়। ওয়াসা এ রকম একটি প্রকল্প নিচ্ছে বলে শুনেছিলাম। ঢাকায় পানির উৎস অত্যন্ত সীমিত। হাইড্রেন্ট থাকাটা নগর-পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত। আধুনিক শহরে বহুতল ভবনে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপক বাহিনীও থাকে, যা আমাদের নেই।
প্রথম আলো: ফায়ার সার্ভিস বলেছে, অগ্নিকাণ্ডের শিকার বনানীর ভবনটির ব্যাপারে তারা ছয়বার চিঠি দিয়েছিল। প্রশ্ন হচ্ছে এটাই যথেষ্ট কি না? নোটিশ দেওয়ার বাইরে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দায় কি ফায়ার সার্ভিসের নেই?
আলী আহমেদ খান: ঢাকার যে জঞ্জাল, তা এক দিনে হয়নি। ষাট, সত্তর, আশির দশকে অনেক বহুতল ভবন হয়েছে। তারা বিল্ডিং কোড বা ফায়ার কোড মেনে দালান তৈরি করেনি। আড়াই বছর আগে রাজধানীর বহুতল ভবনগুলোর ওপর আমরা সমীক্ষা চালাই। স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, হাসপাতাল ও যেখানে জনসমাগম রয়েছে, সেসব জায়গার বহুতল ভবনগুলোকে চিঠি দিয়েছি। তাদের দেওয়া সময়সীমা আগামী দুই মাসে শেষ হবে। আমরা বলেছিলাম, তাদের ফায়ার সেফটি প্ল্যান এবং বিরাজমান ঝুঁকি মূল্যায়ন করতে হবে। আমরা তখন ১০ ভাগ ভালো পেয়েছিলাম। প্রথম চিঠি দেওয়ার পর আরও ১০ ভাগ ব্যবস্থা নিয়েছে। আইন প্রয়োগে বিভাগের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। আমাদের কোনো আলাদা প্রসিকিউশন বা তদন্ত সেল নেই। একজন পরিদর্শককে মামলা করতে হয়। কিন্তু তারপর দেখা যায় ওই পরিদর্শকই আসামি হয়ে গেছেন।
প্রথম আলো: লোকবল সংকট? ছয় বছর মহাপরিচালক থাকতে আপনি কতগুলো ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন?
আলী আহমেদ খান: রাজধানীতে ১১৮ জন পরিদর্শক। সারা দেশে প্রায় ২০০। কয়েকটি ক্ষেত্রে ভবন বন্ধে চিঠি দেওয়ার পর তারা হাইকোর্টে গিয়েছে। তারা রিট করেছে। তবে আমরা মামলা করেছি। ঢাকা ও চট্টগ্রামে ৫০ থেকে ৬০টি মামলার কথা আমি স্মরণ করতে পারি। আমাদের যে লোক অপারেশন করছে, সেই লোক তদন্ত করছে, সেই লোকই মামলা করছে।
প্রথম আলো: আপনারা সরকারকে জানিয়েছেন?
আলী আহমেদ খান: আমরা ঢাকায় তিনজন ও চট্টগ্রামে দুজন ম্যাজিস্ট্রেট দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় পড়ে তাতে অগ্রগতি ঘটেনি।
প্রথম আলো: আপনাদের ওয়েবসাইটে মহাপরিচালকের তরফে দেওয়া বিবৃতিতে বলা আছে, বর্তমান সরকারের আমলে অগ্নিনির্বাপণে ‘স্বর্ণযুগ’এসেছে। কিন্তু ধূসর দিকগুলোর বিষয়ে কী বলবেন?
আলী আহমেদ খান: বর্তমান শাসনামলে ফায়ার সার্ভিসের আধুনিকায়ন ঘটেছে। সামর্থ্য বাড়ানো হয়েছে। যদিও আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে উন্নতি হয়নি। সেখানে আমরা একটা সংস্কারের পর্যায় অতিক্রম করছি। নানামুখী সংস্কার প্রস্তাব সরকারের কাছে দেওয়া রয়েছে। আইনগত সীমাবদ্ধতার কারণেই যেসব প্রতিষ্ঠান অগ্নিনির্বাপণের শর্তাবলি পালন করেনি, তাদের আমরা বন্ধ করে দিতে পারিনি। এটা নিয়ে দুই বছর ধরে আইন মন্ত্রণালয় এবং আমাদের (স্বরাষ্ট্র) মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি চলছে। এর সুরাহা হলে আমরা ভালোভাবে আইনগত ব্যবস্থা নিতে এবং রাজস্বও বাড়াতে পারব।
প্রথম আলো: আপনাদের সিটিজেন চার্টার অনুযায়ী, সব মালিক বা ভাড়াটেকে অগ্নিনিরাপত্তার শর্ত পূরণবিষয়ক সনদ নিতে হবে। পুরোনো ভবনগুলোতে নতুন কেউ ভাড়া নিলে অকুপেন্সি বা ব্যবহারযোগ্য সনদ নেওয়া বাধ্যতামূলক। আপনাদেরই এই সনদ দেওয়ার কথা। এই সনদ তারা পায় কী করে?
আলী আহমেদ খান: এ ধরনের একটি সনদ নিতে পরিচালক পর্যায় পর্যন্ত আসতে হয়। যে কেউ চাইলেই পায় না। বিভাগীয় কেউ সরেজমিনে পরিদর্শন না করলে সনদ জারি হতে পারে না। এসব দেখার জন্য একটি কমিটিও আছে। আসল কথা হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষই সনদ নেয় না।
প্রথম আলো: তাহলে ৮০ ভাগ ইমারত চলছে কী করে? আইন তো মহাপরিচালককে বন্ধ করার আদেশ ঘোষণার ক্ষমতা দিয়েছে।
আলী আহমেদ খান: পুরোনো যারা বহুতল ভবন করেছে, কিন্তু শর্ত পূরণ করেনি, তারা আমাদের সনদ দেখাতে পারবে না। সাম্প্রতিক অতীতেও আমরা কিন্তু এ বিষয়ে সার্কুলার দিয়েছিলাম। যঁারা আইন মানতে চান, তাঁরাই এসেছেন। তাঁরা সংখ্যায় কম।
প্রথম আলো: এই সমস্যা তা হলে কীভাবে দূর হবে?
আলী আহমেদ খান: যারা শর্ত মানবে না, তাদের ভবন বন্ধ করে দিতে হবে, জরিমানা করতে হবে। কিন্তু বর্তমান আইনে আমরা তা করতে পারি না। ফায়ার সার্ভিসকে আরও শক্তিশালী করতে হবে। আইনে সংশোধনী আনতে হবে। ফায়ার সার্ভিস একটি রেগুলেটরি বডি। সেই বিবেচনায় তাকে আরও বেশি ক্ষমতা ও লোকবল দিতে হবে।
প্রথম আলো: বর্তমান ফায়ার কোড হালনাগাদ করা হয়েছে, সে বিষয়ে কি আপনি সন্তুষ্ট?
আলী আহমেদ খান: না। এর অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২০০৩ সালের অগ্নিনির্বাপণ আইন বলেছে, ছয়তলার বেশি ভবন হলেই আমরা সনদ দেব। অন্যদিকে রাজউকের যে বিধি রয়েছে, তা এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তারা বলেছে, ১০ তলার বেশি হলে শুধু তাদের সনদেই চলবে। আমরা দেখেছি, রাজউকের উৎসাহে সংকীর্ণ রাস্তার পাশে বহুতল ভবন হয়েছে আমাদের উপেক্ষা করে। দেশের অগ্নিনির্বাপণের রেগুলেটরি বডিকে এভাবে অগ্রাহ্য করলে তো বড় বিপর্যয় হবেই।
প্রথম আলো: আপনাদের বার্ষিক প্রতিবেদনগুলো বলছে, চুলার আগুন, বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ও জ্বলন্ত সিগারেট ৫০ ভাগের বেশি আগুনের উৎস। কারণ কী?
আলী আহমেদ খান: এটা একটা উপমহাদেশীয় প্রবণতা বলতে পারেন। আসলে ৬০ থেকে ৬৫ ভাগ অগ্নিকাণ্ডের মূল বিদ্যুৎব্যবস্থা। এর কারণ আমাদের দেশে ইলেকট্রিক অডিটিং সিস্টেম নেই। এটা বিশ্বের বহু দেশে রয়েছে। আমরা আইন যে সংশোধনী প্রস্তাব দিয়েছি, তাতে আমরা বলেছি ইলেকট্রিক সেফটি থাকতে হবে। একবার সঠিকভাবে ওয়্যারিং করার অর্থ এই নয় যে, ওটা একটা দীর্ঘমেয়াদি রক্ষাকবচ। এটা অডিট করার জন্য নির্দিষ্ট অডিট ফার্ম থাকবে। আমরা ৫০টি ফার্মকে বলেছিলাম, আপনারা ফায়ার সেফটি প্ল্যান নিশ্চিত করবেন। এটা চালু করতে হলে আইনগত পরিবর্তন আনতে হবে। ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক প্রধান থাকবেন। কিন্তু এটা আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে করতে হবে। এই অডিট রিপোর্টের ভিত্তিতে আমরা তাদের দেওয়া অকুপেন্সি সনদ নবায়ন করব। অন্যথায় করব না। এই ক্ষেত্রে বিশ্বে যে বিধান রয়েছে, বিলম্ব না করে সেটাই আমাদের নিতে হবে। আপনি জেনে খুশি হবেন যে ইউএনডিপির সহায়তায় আমাদের বিভাগটি সংস্কারে একটি উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পেশাদারি সংস্থাগুলোকে পথ দেখাতে হবে। একা ফায়ার বিভাগের পক্ষে সবদিক সামাল দেওয়া সম্ভব নয়। আসলে আমরা তো আগুন নেভাতেই শশব্যস্ত।
প্রথম আলো: তাজরীন, রানা প্লাজা এবং সবশেষ চকবাজারের দুর্ঘটনা আপনি মোকাবিলা করে এলেন।
আলী আহমেদ খান: প্রতিটি দুর্ঘটনাই দুঃখজনক। কিন্তু তা অভিজ্ঞতা অর্জনেরও সুযোগ এনে দেয়। তাজরীন ও রানা প্লাজার পর ক্রেতাদের চাপে পড়ে বিরাট পরিবর্তন এসেছে গার্মেন্টস খাতে। তাই বলে এখন গার্মেন্টসে আগুন লাগা বন্ধ হয়েছে, তা নয়। কিন্তু মানুষ মারা যাওয়ার সংখ্যা কমেছে। একই অভিজ্ঞতা বাকি সব ক্ষেত্রে কাজে লাগাতে হবে। আমরা বড় উন্নয়নের দিকে যাচ্ছি। আইনের সংঘাত ও সমন্বয়হীনতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আপনি জেনে বিস্মিত হবেন যে দেশে হাজারো ভবন তৈরি হয়েছে এবং হচ্ছে অগ্নিনির্বাপণ বিভাগকে না জানিয়ে।
প্রথম আলো: ২০১৭ সালের জানুয়ারিতে গুলশানের কিচেন মার্কেটে আগুন লাগল, তখন আপনি মহাপরিচালক ছিলেন। পুড়ে যাওয়া স্থানেই নতুন স্থাপনা হলো এবং সেখানে কোনো অগ্নিনিরোধক কিছুই ছিল না। এই ব্যর্থতার দায় কার?
আলী আহমেদ খান: এই বিষয়ে আমি বলব সিটি করপোরেশন আমাদের সম্পূর্ণরূপে উপেক্ষা করেছিল। ওই মার্কেটের পাশে আরও একটি তিনতলা মার্কেট রয়েছে। এই দুটি মার্কেটের বিষয়েই আমরা লিখিত আপত্তি দিয়েছিলাম। কিন্তু সিটি করপোরেশন কার্যত আমাদের আপত্তি ও অগ্নিনিরাপত্তা–সংক্রান্ত উদ্বেগ অগ্রাহ্য করেছিল। আমরা বলেছিলাম, এই মার্কেট অবৈধ। সিটি করপোরেশন আমাদের কাছে জানতে চেয়েছিল এটা চালু করা যায় কি না? আমরা বলেছি যে এটা করা যাবে না। পরে জানলাম ভেতরে অন্য কাহিনি। মার্কেটের জায়গা ও দোকানের দখল নিয়ে দ্বন্দ্ব দেখা দেওয়া ও তা মেটাতেই মার্কেট চালু করা হয়। আমরা আর অগ্রসর হইনি। আমরা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলাম।
প্রথম আলো: কী ধরনের সংস্কার চান?
আলী আহমেদ খান: সারা বিশ্বে লোকসংখ্যার অনুপাতে ফায়ার সার্ভিসের কর্মী সংখ্যা ঠিক হয়। ঢাকা শহরের জন্য ৩৫ হাজার পুলিশ আছে। অথচ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী সংখ্যা ৫০০–র নিচে। অগ্নিনির্বাপণে আমাদের স্যাটেলাইট স্টেশন থাকতে হবে। যানজটের কারণে ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থায় যে অতিরিক্ত চ্যালেঞ্জ, সেটা মোকাবিলায় উপযুক্ত পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছালে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু মাঝখানে আমলাতান্ত্রিক অনেক বাধা রয়েছে। যে কারণে আমাদের অনেক সংস্কার পিছিয়ে গেছে। অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী প্রতিটি উপজেলায় ফায়ার সার্ভিস বসবে। দেখুন যার যা কাজ সেটা তাকেই করতে দিতে হবে। হেলিকপ্টার এসে আগুনটা বাড়িয়ে দিল। এনটিভিতেও একই ভুল আমরা দেখেছিলাম। অথচ আমাদের মা–দাদিরা জানেন ফুঁ দিয়ে কীভাবে চুলার আগুন আরও বাড়ানো যায়। সন্ত্রাসী হামলা প্রতিরোধে পুলিশের কর্তৃত্বে সব বাহিনীকে সমবেত হতে হয়। একইভাবে আগুনের ক্ষেত্রে সব বিভাগকেই ফায়ার সার্ভিসের নেতৃত্বে শামিল হতে হবে। পরস্পরকে দোষারোপ নয়, আমাদের পেশাদারিত্ব ও সমন্বয়হীনতার ঘাটতি কাটিয়ে উঠতে হবে।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
আলী আহমেদ খান: ধন্যবাদ।