পরীক্ষার চাপে নষ্ট শৈশব

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

ঢাকার একটি স্বনামধন্য স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া দারুণ উচ্ছল প্রতিবেশী ছেলেটিকে ভীষণ ভালো লাগে আমার। ছেলেটি খুব ভালো ফুটবল খেলে। রোজ বিকেলে হাঁকডাক করে আশপাশের ফ্ল্যাটের ছেলেমেয়েদের একত্র করে বাসার নিচে খেলতে নামে সে। তবে বেশ কদিন হলো বিকেলটা কেমন শান্ত; কেউ খেলতে নামে না। এরই মধ্যে একদিন সন্ধ্যায় দেখা হয় ছেলেটির সঙ্গে। জিজ্ঞেস করি, ‘ভালো আছ? আজকাল খেলতে নামো না যে!’ ছেলেটি মাথা
নেড়ে কোনো রকমে জবাব দেয়, সে ভালো আছে। তবে তার চোখে পানি টলটল করে। সে বলে, ‘এ বছর জেএসসি পরীক্ষা। বিকেলে কোচিংয়ে যাই, তাই খেলতে পারি না।’ ছেলেটির কথাগুলো হৃদয় ছুঁয়ে যায় আমার। পরে শুনেছি, ছেলেটি নাকি স্কুল থেকেই সরাসরি কোচিংয়ে চলে যায়। গাড়িতে বসেই খেয়ে নেয় দুপুরের খাবার। গাড়িতেই পোশাক পরিবর্তন করে কোচিং সেন্টারে যায় সে। আবার সন্ধ্যায় আসে গৃহশিক্ষক।

অন্যদিকে, নিচতলার সাড়ে পাঁচ বছর বয়সী শিশুটি পড়ে নামী একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে কেজি ওয়ানে। সে কয়েক দিন থেকে স্কুলে যেতে চাইছে না। স্কুলে পড়ার ভীষণ চাপ। তাকে আয়ত্ত করতে হচ্ছে প্রশ্নোত্তর লেখার কায়দাকানুন। এ ছাড়া রয়েছে দুই সংখ্যার যোগ-বিয়োগ শেখার বিড়ম্বনা। স্কুল থেকে ডেকে পাঠানো হয়েছে তার মা-বাবাকে।

বলা হয়েছে বাসায় শিশুটির পড়ার ব্যাপারে আরও যত্নবান হতে। তাই মা-বাবার মনে শান্তি নেই। যেহেতু তাঁরা জানেন স্কুল এবং শিক্ষাব্যবস্থাকে পরিবর্তন করা অসম্ভব, তাই শিশুটির পরিবর্তনকেই সহজ সমাধান বলে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। তাঁরা মনে করেন, এই সিলেবাস কোনোভাবেই শিশুটির বয়স বিবেচনা করে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু উপায় কী! তাই ইচ্ছার বিরুদ্ধেই স্কুলে টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে যাবতীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে হচ্ছে শিশুটির ওপর।

এই অভিজ্ঞতাগুলো কিন্তু বিচ্ছিন্ন অভিজ্ঞতা নয়। ঘরে ঘরে শিশু-কিশোর এবং তাদের অভিভাবকেরা এই পরিস্থিতিকেই বাস্তবতা বলে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে বলা হচ্ছে শিশুদের ওপর পড়ার চাপ কমানোর কথা। এই তো কয়েক দিন আগে প্রাথমিক শিক্ষা সপ্তাহ, ২০১৯-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলছেন, ‘শিশুদের পড়ার জন্য অতিরিক্ত চাপ দেবেন না। তাহলেই দেখবেন তারা ভেতরে একটা আলাদা শক্তি পাবে। তাদের শিক্ষার ভিতটা শক্তভাবে তৈরি হবে।’ কিন্তু এসব আহ্বানের কোনো বাস্তব প্রতিফলন দেখি না প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায়। কি ইংরেজি মাধ্যম, কি বাংলা মাধ্যম, কি কিন্ডারগার্টেন—কোথাও স্বস্তি নেই শিক্ষার্থীদের।

কিছুদিন আগে বিশ্বব্যাংক প্রকাশিত ‘ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৮: লার্নিং টু রিয়েলাইজ এডুকেশন প্রমিজ’-এ বেরিয়ে এসেছে যে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে শুরু করে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১১ বছরের স্কুলজীবনের মধ্যে সাড়ে চার বছর সময়ই নষ্ট হচ্ছে দুর্বল শিক্ষাপদ্ধতির কারণে। প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল স্টুডেন্ট অ্যাসেসমেন্ট ২০১৫ ’-এ দেখা গেছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ৩৫ শতাংশ বাংলায় এবং পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ২৫ শতাংশ গণিতে কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। মূলধারার শিক্ষাদান-পদ্ধতি, কারিকুলাম, শিক্ষকদের গুণগত মান ইত্যাদি নিয়ে বহুদিন ধরেই রয়েছে নানা বিতর্ক।

পরীক্ষানির্ভর শিক্ষাব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা এই স্রোতোধারায় গাইড বই এবং কোচিং-বাণিজ্যের জয়জয়কার। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের অধিকাংশ শিক্ষক এখনো অর্জন করতে পারেননি সৃজনশীল পদ্ধতিতে প্রশ্ন করার যোগ্যতাটুকু। অন্যদিকে, কিন্ডারগার্টেন ও ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোর ওপর নেই সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ। ওই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা দেওয়ার নামে শিক্ষার্থীর ওপর অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দিচ্ছেন বইয়ের বোঝা। যেন রোবট-মানব বানানোর ব্রত নিয়ে তাঁরা বাজারে অবতীর্ণ হয়েছেন। রোবটে যে যত বেশি ইনপুট দিতে পারছে, সেই রোবটের বাজার কাটতি তত বেশি।

মিথ্যা প্রতিযোগিতা আর মানসিক চাপ নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুদের মধ্যে সারা জীবনের জন্য বৈকল্য সৃষ্টি হচ্ছে, তৈরি হচ্ছে একধরনের মানসিক দৈন্য। এ ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা শিশুর শৈশবকে বিবর্ণ করছে, তাকে স্বার্থপর ও অসামাজিক করে তুলছে, তাদের দলীয় মনোভাব ও নেতৃত্বের স্পৃহা নষ্ট করছে, নান্দনিক অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিচ্ছে; সর্বোপরি তাদের মানুষ নয়, বরং যন্ত্রে পরিণত করছে। অতিরিক্ত বইয়ের চাপে ফিকে হয়ে আসা তাদের বিবর্ণ শৈশবের বেদনা কেউ বোঝে না; বুঝলেও করার কিছু থাকে না। ওদের দেখে কেবলই মনে পড়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘তোতাকাহিনী’র কথা, যেখানে প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর পাখিটির মৃত্যু হয়েছিল শিক্ষালাভের অত্যাচারে।

স্কুলপড়ুয়া এই শিশু-কিশোরদের জন্য ভয় হয়! রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘তোতাকাহিনী’ শেষ করেছিলেন এভাবে, ‘পাখি আসিল। সঙ্গে কোতোয়াল আসিল, ঘোড়সওয়ার আসিল। রাজা পাখিটাকে টিপিলেন, সে মুখ হাঁ করিল না, হু করিল না। কেবল তার পেটের মধ্যে পুঁথির শুকনো পাতা খসখস গজগজ করিতে লাগিল।’ আমাদের সন্তানদের অবস্থাও যে অনেকটা ‘তোতাকাহিনী’র পাখির মতো, কর্তাব্যক্তিরা কি তা মানেন?

নিশাত সুলতানা: লেখক ও গবেষক
[email protected]