ভারতে আর দুই মাস পর নির্বাচন। এই নির্বাচন নিয়ে সমগ্র ভারতে একধরনের উত্তাপ ছড়াচ্ছে কট্টর হিন্দুপন্থী-প্রভাবিত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি; অন্যদিকে কংগ্রেসসহ বিভিন্ন রাজ্যের বিরোধীদের জোট। বিরোধী জোটগুলোর মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল এবং এর নেতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য (পার্লামেন্টে আসনের কারণে) উত্তর প্রদেশের বিরোধী সমাজবাদী ও বহুজন সমাজবাদী পার্টির নিখিলেশ যাদব ও মায়াবতী। এরই মধ্যে কয়েকটি রাজ্য সরকার নির্বাচনে কংগ্রেস বিজয় পেয়েছে। বিশেষ করে নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটে তা বিজেপির জন্য চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইতিমধ্যেই সোনিয়া-রাজীবের কন্যা প্রিয়াঙ্কা ভদ্র গান্ধী কংগ্রেসের রাজনীতিতে সক্রিয় হওয়ায় উত্তর প্রদেশের রাজনীতির ছক বদলের ইঙ্গিত মিলছে। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট গঠনের প্রচেষ্টায় শামিল হয়েছে দক্ষিণের অনেক রাজ্যের বিভিন্ন দল। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি শাসক দলও রয়েছে। একইভাবে পূর্ব ভারতের কয়েকটি রাজ্যের সরকারি ও অন্যান্য দলও এই প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে।
একদিকে প্রায় পাঁচটি রাজ্যে মোদি সরকারের ও বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। অন্যদিকে বিশিষ্ট কয়েকজন শিল্পপতিকে তোষামোদ করে চলার এবং বড় বড় ব্যবসায়িক সুবিধা দেওয়ার অভিযোগ উন্মোচন করছে বিরোধী দল। ফ্রান্সের যুদ্ধবিমান রাফায়েল কেনার ক্ষেত্রে ভারতের শীর্ষ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রিলায়েন্স গ্রুপকে সুবিধা দিয়ে চড়া মূল্যে খরিদ করার বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে চর্চিত ও আলোচিত। অন্যদিকে সরকারও বসে নেই।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁর সরকারের চিটফান্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার তদন্ত নিয়ে সমগ্র ভারতে তোলপাড় হয়েছে। একই সঙ্গে সিবিআই মায়াবতীর মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে, হাতি পার্কের কথিত দুর্নীতি এবং প্রিয়াঙ্কার স্বামী রবার্ট ভদ্রের দ্রুত ধনাঢ্য হওয়ার বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে। মোদি সরকার পাঁচ বছরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে চমক দেখাতে চেয়েছিল, তা অর্জন করতে পারেনি। নতুন কর্মসংস্থানের পরিস্থিতিও তৈরি করতে পারেনি। মোদির ডিমনিটাইজেশন ভারতের অর্থনীতিকে চাঙা করা দূরে থাক বরং ভারতের গরিব ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। মোদি শাসনের পাঁচ বছরে ভারত আগের তুলনায় অনেক বেশি সাম্প্রদায়িক হয়ে উঠেছে।
এই পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে বিজেপির ২০১৪ সালের নির্বাচনের মতো ব্যাপক বিজয়ের বিষয়টি ক্রমেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে উঠছে। ভারতের অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলকাতায় আমার পরিচিত একাধিক বিশিষ্টজনও মোদির পুনর্নির্বাচিত হওয়া নিয়ে সন্দিহান। গত মাসের প্রথম দিকে অনেকের মুখেই এমন কথা শোনা গেছে যে মোদি নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার জন্য জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ ব্যবহার করার চেষ্টা করবেন। মোদি সন্ত্রাসের
বিরুদ্ধে তাঁর বলিষ্ঠ অবস্থান এবং প্রয়োজনে সীমান্ত অতিক্রম করে সন্ত্রাস দমনের উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়গুলো তুলে ধরার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে কংগ্রেস যে এ বিষয়ে উদাসীন, তা-ও তুলে ধরার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে বলিউডের অবদানও কম নয়। বেশ কিছু চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মোদির জাতীয়তাবাদী চেতনা তুলে ধরার উদ্যোগ রয়েছে। এর মধ্যে উড়ি নামের চলচ্চিত্রে ২০১৬ সালে পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গিদের উড়িতে হামলা এবং তার প্রতিক্রিয়ায় বিজেপি ও নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের’ ঘটনার মাধ্যমে ভারতীয়দের জাতীয়তাবাদী চেতনাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা লক্ষণীয়।
মোদি যখন ভারতীয়দের দেশপ্রেম, জাতীয়তাবাদ এবং ভারতের সামরিক বাহিনীর ওপর জনগণের আস্থা ও ভালোবাসার আবেগকে ব্যবহার করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, সেই পরিস্থিতিতেই গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের জম্মু শ্রীনগর হাইওয়ে-৪৪-এর পুলওয়ামা জেলায় ঘটে গেল বড় এক আত্মঘাতী জঙ্গি হামলা। এই হামলায় আধা সামরিক বাহিনী সিআরপিএফের ৪০ সদস্য নিহত হন। সাম্প্রতিক সময়ে এটা এক বড় হামলা এবং পাকিস্তানের মদদ ও সমর্থনপুষ্ট হিসেবে বিবেচিত জঙ্গি সংগঠন জইশ-ই-মুহাম্মদ এর দায়িত্ব স্বীকার করে। এই হামলা মোদিকে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রমাণের যেমন সুযোগ করে দেয়, তেমনি কিছু করতে না পারলে তার প্রভাবও নির্বাচনের ওপর পড়তে পারে।
সরকারের তরফ থেকে প্রতিশোধ নেওয়ার সংকল্প ভারতবাসীকে যুদ্ধংদেহী মনোভাবের দিকে নিয়ে গিয়েছিল। এর ফল হিসেবেই ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালায়। ভারতের দাবি, এই হামলায় ৩০০ জঙ্গি নিহত হয়েছে। নরেন্দ্র মোদি জনসাধারণকে জানালেন, তাঁর হাতে ভারত সুরক্ষিত। তবে এখনো ক্ষয়ক্ষতির দাবির সপক্ষে প্রমাণ তুলে ধরেননি। অন্যদিকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের জন্য ভারতের হুমকি মোকাবিলা ছিল তাঁর নেতৃত্বের প্রতি সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। দুই বৈরী দেশের বেশির ভাগ মানুষ প্রতিশোধ আর যুদ্ধের ডামাডোলে পতিত হয়। পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ভারতের কাশ্মীর সীমান্তে গোলাবর্ষণ করে। পাকিস্তান দুটি ভারতীয় বিমান ভূপাতিত এবং বৈমানিককে আটকের দাবি করে। ভারত প্রথমে অস্বীকার করলেও পরে একটি বিমান হারানো এবং বৈমানিকের আটকের বিষয়টি স্বীকার করে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন এবং আটক ভারতীয় বৈমানিককে তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল, তা আপাতত শান্ত হয়েছে।
কাশ্মীর সমস্যাকে কেন্দ্র করে বিজেপি তথা মোদি ভারতীয়দের উগ্র জাতীয়তাবাদের দিকে ঠেলে দেওয়ার চেষ্টার পাশাপাশি পুলওয়ামা হামলার প্রতিক্রিয়ায় পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে এবং কার্যত যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে কী ফল ঘরে তুলতে পারবেন, তা দেখার বিষয়। কিন্তু এমন যেকোনো পরিস্থিতি উপমহাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবে, তাতে সন্দেহ নেই। বিশ্ববাসীর এবং দুই দেশের শান্তিপ্রিয় জনগণের স্বাভাবিক আকাঙ্ক্ষা থাকবে সংঘাতের পথ পরিহার করে আলোচনার মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান করা। দেশ দুটির নেতারা তাঁদের নিজস্ব রাজনীতি ও নেতৃত্ব বজায় রাখার স্বার্থে পদক্ষেপ নিলে এই পুরো অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আঞ্চলিক দেশগুলোও এ উত্তেজনা প্রশমনে ভূমিকা পালন করতে পারে। যুদ্ধ কোনো সমস্যার সমাধান নয়, বরং আরও জটিল সমস্যার জন্ম দেয়।
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ উসকে দেওয়া ছাড়াও মোদি সরকার বিশাল সামরিক, আধা সামরিক ও বেসামরিক বাহিনীতে তাদের গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে এবং ভোটব্যাংক নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলার তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতের সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনী এবং তাদের পোষ্যরা মিলে বিশাল এক ভোটব্যাংক। ভারতে কর্তব্যরত সৈনিকদের জন্য প্রক্সি ভোটের ব্যবস্থা রয়েছে। কাজেই ভোটের অঙ্কে এই ভোটব্যাংক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
ভারত-পাকিস্তানের উত্তেজনার মূলে কাশ্মীরে জঙ্গি হামলার ঘটনা হলেও ভারতের জাতীয় নির্বাচনের ঠিক আগে এসব ঘটনার বড় রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে। মোদি এ ঘটনা থেকে কোনো ফল পাবেন কি? পুলওয়ামার জঙ্গি হামলা, পরবর্তী সময়ে ভারতের বিমানবাহিনীর হামলা এবং পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় ক্ষয়ক্ষতি, আটক ভারতীয় বৈমানিককে মুক্তি দেওয়া, পাকিস্তানের আলোচনার প্রস্তাব—এই প্রেক্ষাপটে পুরো বিষয়টি কতটা মোদির পক্ষে বা কতটা বিপক্ষে যাবে, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে।
ড. এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার ও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, বর্তমানে এনএসইউর অনারারি ফেলো