আমাদের দেশটি বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের একটি অদ্ভুত দেশ। এ দেশে সবচেয়ে বেশি পরীক্ষার কবলে পড়ে ছোটদের পরীক্ষা। ফলে আমাদের শিশু-কিশোরদের শৈশব আর কৈশোর হারিয়ে যায় অপ্রয়োজনীয় কতগুলো পাবলিক পরীক্ষার চাপে। এ দেশে ১২ বছরের শিক্ষাজীবনে চার–চারটি পাবলিক পরীক্ষা দিতে হয়। আর পরীক্ষাগুলোতে যে দক্ষতা দেখা হয়, সেটি কেবল মুখস্থবিদ্যার। এমনকি শারীরিক শিক্ষা বিষয়ের লিখিত পরীক্ষা হয়, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরীক্ষার খাতায় লেখে কীভাবে সাঁতার কাটতে হয়, কিন্তু বেচারাদের কেউ সাঁতার শিখতে পানিতে নামতে বলে না।
পাবলিক পরীক্ষার সময় আমি খুব ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কিছু বিষয় লক্ষ করি। আমি লক্ষ করি কোনো একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা পঞ্চম শ্রেণির পড়ুয়াদের পরীক্ষায় নকল করার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেন। আমি দেখি মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ ব্যক্তি সংবাদ সম্মেলন করে জানান, শিক্ষার্থীদের এবার একটু ‘টাইট’ দেওয়া হয়েছে; তাই জিপিএ–৫–এর সংখ্যা কমে গেছে। এসব করতে করতে কখন যে আমাদের শিক্ষার্থীরা শুধুই পরীক্ষামুখী হয়ে গেছে, তা আমরা খেয়ালই করিনি। তাদের ধ্যান-জ্ঞানে এখন আর কিন্তু শিক্ষা নেই। সবটা জুড়ে আছে পরীক্ষা আর যেনতেনভাবে সেখানে তথাকথিত ভালো ফলাফল করার প্রতিযোগিতা।
এই যেমন বরিশালের গৌরনদীর একটি কেন্দ্রের এসএসসি পরীক্ষার্থীরা। চলমান পরীক্ষায় গণিতের প্রশ্নপত্র ‘কঠিন’ হওয়া ওবং পরীক্ষার কেন্দ্রে ‘কড়াকড়িভাবে’ পরীক্ষা নেওয়ার প্রতিবাদে ৯ ফেব্রুয়ারি তারা মহাসড়ক অবরোধ করে। দৈনিক যুগান্তর–এ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘গণিতের প্রশ্ন কঠিন হওয়ার প্রতিবাদে ও পুনরায় এই পরীক্ষা নেওয়ার দাবিতে শনিবার বেলা সোয়া একটার দিকে উপজেলার বার্থী মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরীক্ষাকেন্দ্রে ও কেন্দ্রের সামনে ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে এ বিক্ষোভ করে শিক্ষার্থীরা। ...ওই কেন্দ্রের একাধিক পরীক্ষার্থী জানায়, চলতি এসএসসি পরীক্ষার গৌরনদী উপজেলার বার্থী তারা মাধ্যমিক বিদ্যালয় পরীক্ষাকেন্দ্রে উপজেলার বার্থী, মেদাকুল, ধানডোবা, বাকাই, খাঞ্জাপুর, বাউরগাতি হাইস্কুলের ৭০৮ জন পরীক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ নেয়। চলতি এসএসসি পরীক্ষা শুরু থেকে পরীক্ষাকেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা পরীক্ষার্থীদের ঘাড় ঘোরাতে দিচ্ছেন না। এমনকি গণিত পরীক্ষার প্রশ্ন কমন না পড়ায় ইউএনও এবং কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাসহ দায়িত্বপ্রাপ্ত শিক্ষকেরা পরীক্ষার সময় কোনো পরীক্ষার্থীকে ঘাড় ঘোরাতে দেননি ও কোনো সুযোগও পায়নি।’
বটে! অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে পরীক্ষার প্রশ্ন করার কাজটাও শিক্ষার্থীদের দিতে হবে। পত্রিকায় এ খবর পড়ার সময় আমার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা, বিশেষ করে পরীক্ষার প্রশ্নের বিবর্তন নিয়ে চলমান একটি ট্রলের কথা মনে পড়েছে। এই ব্যঙ্গাত্মক ছবিতে পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রের একটি বিবর্তন দেখানো হয়েছে। ১৯৭০ সালে গণিতের পরীক্ষায় একটি অনিয়মিত বস্তুর উপরিতলের ক্ষেত্রফল বের করতে বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, এই সমস্যার সমাধান করতে হলে শিক্ষার্থীকে কেবল আয়তাকার ক্ষেত্রের ক্ষেত্রফল বের করার পদ্ধতি জানলেই হবে না, বাড়তি কিছু জানতে হবে। ১৯৮৫ সালে সেটিকে কেবল একটি আয়তক্ষেত্রে রূপ দেওয়া হয়। প্রশ্নকর্তা আশা করছেন আয়তক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য প্রস্থকে গুণ করে এর ক্ষেত্রফল পাওয়া যায়, সেটি শিক্ষার্থী জানে। ২০০০ সালে উদ্দিষ্ট ক্ষেত্রফল বের করার জন্য দৈর্ঘ্যকে প্রস্থ দিয়ে গুণ করার কথাটি প্রশ্নে উল্লেখ করে দেওয়া হয়। এরপর ২০১০ সালে বহুনির্বাচনী পরীক্ষায় এসে দেখা যায় গুণফল হিসেবে তিনটি সংখ্যা দিয়ে দেওয়া হয়, যার মধ্যে দুটিই অনেক বড়। এরপর ২০১৫ সালে বহুনির্বাচনী অপশনে সম্ভাব্য উত্তরে থাকে মাইকেল জ্যাকসন, কানাডা, ব্রেকফাস্ট ও ৬০০! এর মানে হলো তখন আমাদের জানার উদ্দেশ্য হলো দুটি সংখ্যার গুণফল একটি সংখ্যা যে হয়, সেটি পরীক্ষার্থীরা জানে কি না। সবশেষে ২০১৮ সালের প্রশ্নে এসব কিছুর ধার না ধেরে বলা হয়েছে নিজের পছন্দমতো রঙে প্রশ্নের আয়তক্ষেত্রটিকে রাঙিয়ে দেওয়ার জন্য।
ব্যঙ্গ করার সময় সবকিছু একটু বাড়িয়েই বলা হয়। কিন্তু এই ব্যঙ্গাত্মক ছবির মূল কথাটি কিন্তু আমাদের বরিশালের শিক্ষার্থীদের আচরণের ব্যাখ্যা। ছোটবেলা থেকে তারা ক্রমাগত ‘সহজ’ প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়েছে, এমনকি সঠিক উত্তর না দিয়েও পরীক্ষায় নম্বর পেয়েছে। এ ছাড়া বিভিন্ন গাইড বই, নোট বই, সাজেশনের কল্যাণে পরীক্ষার প্রশ্নে কোন সমস্যাগুলো থাকতে পারে, সেটিও তার ধারণা হয়ে গেছে। কাজে কখনো যদি তার ব্যতিক্রম হয় তাহলেই সে সংক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। আর এভাবে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্যকে পাশ কাটিয়ে তাদের কাছে পরীক্ষা আর পরীক্ষার ফলাফলই হয়ে উঠছে মুখ্য।
পরীক্ষা যে তাদের অস্থির করে ফেলছে, তার আরেকটি প্রমাণ হলো সরকার কর্তৃক পরিজাতিক প্রাথমিক শিক্ষার্থীর জাতীয় অভীক্ষার ফলাফল। এটি প্রতি দুই বছর অন্তর পরিচালিত হয়, যেখানে তৃতীয় ও পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা অভীষ্ট শিখন-ফল (লার্নিং আউটকাম) অর্জন করেছে কি না, তা দেখা হয়।
২০১১ সালের অভীক্ষা থেকে দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৬৮ শতাংশ বাংলায় তাদের অভীষ্ট শিখন–ফল অর্জন করতে পারে। কিন্তু দুই বছর পরে, ২০১৩ সালে যখন তারা পঞ্চম শ্রেণিতে যাচ্ছে, তখন সে হার কমে হয়ে যাচ্ছে মাত্র ২৫ শতাংশ। গণিতের বেলায় এটি ৫০ শতাংশ থেকে অর্ধেকে কমে এসেছে। একইভাবে ২০১৩ সালের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থীদের শিখন-ফল অর্জনের হার ছিল বাংলায় ৭৫ শতাংশ। অথচ দুই বছর পর, ২০১৫ সালে একই শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাত্র ২৩ শতাংশ এই সাফল্য ধরে রাখতে পারছে। গণিতের বেলায় ২০১৩ সালের ৫৭ শতাংশ ব্যাপকভাবে কমে মাত্র ১০ শতাংশে এসে ঠেকে।
তৃতীয় শ্রেণি আর পঞ্চম শ্রেণির মধ্যে পার্থক্য শুধু একটি—প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী নামে একটি পাবলিক পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় ভালো করার জন্য শিক্ষার্থীরা চতুর্থ শ্রেণি থেকেই পরীক্ষার্থীতে পরিণত হয়। আর শিক্ষকেরাও তাঁদের স্কুলের সাফল্য ধরে রাখতে কেবল পরীক্ষার বিষয়গুলোকেই গুরুত্ব দেন।
আর এভাবে আমরা তৈরি করছি একটি শুধু পরীক্ষামুখী শিক্ষার্থী সমাজ, যারা ক্রমাগত অস্থির হয়ে উঠছে এবং পরীক্ষায় ‘সহজ’ প্রশ্নে জিপিএ–৫ পাওয়াটাকেই জীবনের একমাত্র মোক্ষ ভাবছে। বিষয়টা যত তাড়াতাড়ি আমাদের নীতিনির্ধারক ও শিক্ষা আমলারা বুঝতে পারবেন, তত তাড়াতাড়ি আমরা এ চক্র থেকে বের হতে পারব।
মুনির হাসান প্রথম আলোর যুব কর্মসূচি সমন্বয়ক