একুশে ফেব্রুয়ারির প্রাক্কালে ভাষাশহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করার জন্য যখন আমাদের সকল মনোযোগ একই দিকে নিবিষ্ট, সেই সময়ে ঢাকার চকবাজারের চুড়িহাট্টা নামের জনপদটি এক ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল। একুশের শহীদদের শোকের সঙ্গে যুক্ত হলো নাম না জানা অনেকগুলো মানুষের করুণ মৃত্যুর শোক। তাঁরা কোনো বীরোচিত কাজ করার জন্য স্বেচ্ছায় প্রাণ দিতে আসেননি, নেহাতই সাধারণ দৈনন্দিন জীবন নিয়েই ব্যস্ত ছিলেন। এ পর্যন্ত যা হিসাব পাওয়া গেছে তাতে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ‘মৃতে’র সংখ্যা ৮১ ছুঁয়েছে। তবে সরকারি হিসাবে মারা গেছেন ৬৭ জন। এই অগ্নিকাণ্ডে নারী-পুরুষসহ রেহাই পায়নি অবোধ শিশুরাও। এ ঘটনাটিকে ‘দুর্ঘটনা’ বলব, নাকি হত্যাকাণ্ড? যে মানুষগুলো প্রাণ হারালেন, তাঁদের ‘মৃত’ বলা হবে নাকি ‘নিহত’?
তথ্যমতে এই ঘন জনবহুল এলাকায় বহু বসতবাড়ির বেশ কয়েকটির নিচতলা অত্যন্ত সহজে দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করা হয় বা ভাড়া দেওয়া হয়। এই প্রচণ্ড দায়িত্বজ্ঞানহীন কাজটির পরিণামে এই এলাকার বাসিন্দাদের এর আগেও একইভাবে প্রাণ দিতে হয়েছিল। ২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে নিহত হয়েছিলেন ১২৪ জন। সে ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছিল, তার ধাক্কায় প্রশাসনিক নির্দেশনা এসেছিল বিলম্ব না করে ওই অঞ্চল থেকে এ ধরনের গুদামগুলো স্থানান্তরিত করে নেওয়ার। একই নির্দেশনা দিয়েছিলেন মহামান্য আদালত। দোষীদের শাস্তিও দাবি করা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে গণমাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা এবং সরকার অনুগত ব্যক্তিদের কথা শোনা বা পড়ার সময় লক্ষ করে দেখেছি, এসব অন্যায়–অনাচারে তাঁরা বিচলিত হলেন কি হলেন না কিংবা এ ধরনের ঘটনা প্রতিরোধের জন্য তাঁদের কী দায়দায়িত্ব ছিল, সে ব্যাপারে তাঁরা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেন না। তবে তাঁদের একটি অভিন্ন বক্তব্য দেখেছি যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ঘটনায় খুবই ক্ষুব্ধ, ব্যথিত ও উদ্বিগ্ন। নিমতলী ট্র্যাজেডির পরে এ ধরনের বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থের গুদাম এই অঞ্চল থেকে তিনি সরিয়ে নেওয়ার কঠোর নির্দেশ দিয়েছিলেন। এবারেও তিনি একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যে তেমনই নির্দেশ দেবেন, এ ব্যাপারে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। এসব ক্ষেত্রে তাঁর সংবেদনশীলতা সন্দেহাতীত। আমার প্রশ্ন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিয়োজিত তাঁরই অনুগত রাষ্ট্রীয় ও অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা সে নির্দেশ পেয়েও তা বাস্তবায়নের জন্য কী করেছেন?
২০১০ থেকে ২০১৯। ৯ বছর নিরবচ্ছিন্নভাবে একই প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একই সরকার ক্ষমতায়। কোনো বিরোধী পক্ষ এসে তো সরকারের কর্মকাণ্ডে বাধা দিতে পারেনি। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা ‘বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত’ হওয়ার অথবা পদোন্নতিবঞ্চিত হওয়ার মতো কোনো রাজনৈতিক পরিবেশ তো তৈরি হয়নি। তাহলে প্রধানমন্ত্রীর আদেশ-নির্দেশ মানা হলো না কেন? কারা সেই আদেশ–নির্দেশ অবজ্ঞা করলেন? কোন স্বার্থে?
গণমাধ্যমেই দেখছি চকবাজারের ঘটনা নিয়ে সরকারের একেক ব্যক্তি একেক রকম কথা বলছেন। যাঁরা ঘটনার তদন্ত করছেন, তাঁদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের ভাষ্য মিলছে না। কার দোষ বা অবহেলা আড়াল করার জন্য এই অসামঞ্জস্য? আমার মতে, নিমতলী ও চুড়িহাট্টার অগ্নিকাণ্ড নিছক দুর্ঘটনা নয়, বরং অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড। আইনের দৃষ্টিতে পরিকল্পনাজনিত হত্যাকাণ্ড বলে এটি গণ্য হবে না বটে, তাই বলে অসচেতনতা বা অজ্ঞানতাপ্রসূত বলে দায়ী ব্যক্তিকে ছাড়ও দেওয়া যাবে না। নিমতলীর অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। সেখানেও দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যাতে না দেখতে হয়, সে জন্য আমরা সাধারণ মানুষেরা নিরপেক্ষ তদন্ত, দোষীদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করা, নিহতদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া, ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা, অবিলম্বে দাহ্য পদার্থের গুদাম স্থানান্তর করা ইত্যাদি সুপারিশ করেই আসছি। কিন্তু সেসব সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কোনো পদক্ষেপ দেখার সৌভাগ্য হয় না। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কাছে আমাদের চাওয়ার কতখানি মূল্য বহন করে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে সে প্রশ্ন তুলতেই হয়। যার যার দায়িত্ব স্বাধীনভাবে সততা, নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে পালন করব, গণতন্ত্রের এই নির্দেশনা সংস্কৃতি থেকে আমরা নিঃসংকোচেই বিদায় দিয়েছি। কিন্তু কর্তাব্যক্তিদের কাছে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ তো শিরোধার্য। এমন নৃশংস হত্যাযজ্ঞ প্রতিরোধ করার ভার যাঁদের ওপর দেওয়া হয়েছে, দয়া করে সে নির্দেশ বাস্তবায়নের ভারটা তাঁরা বহন করুক। আমরা যদি দায়িত্বশীল নাগরিকের মতো আত্মমর্যাদাসম্পন্ন আচরণ করতে শিখতাম এবং তা চর্চা করতে পারতাম, তাহলে নিমতলী বা চুড়িহাট্টার বিপর্যয় এড়ানো যেত।
এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে নাগরিকদের নিজেদের দায়িত্ববোধ বা জবাবদিহি নিয়েও প্রশ্ন তোলার অবকাশ আছে। কিন্তু নাগরিকের দায়িত্ববোধ তৈরি ও বিকাশের জন্য সুশাসন প্রতিষ্ঠা একটি অতি আবশ্যক শর্ত। যাঁরা এই শোকাবহ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তাঁরা কোন সাহসে বা কার প্রশ্রয়ে সব আদেশ-নির্দেশ অবজ্ঞা করে দিনের পর দিন পার করে দিতে পারছেন? বছরের পর বছর ধরে তাঁদের আইন অমান্য করার প্রবণতা কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা নগররক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হয় না?
বাংলাদেশ দৃঢ় পায়ে উন্নয়নের পথে এগিয়ে চলেছে। আমাদের প্রত্যয়, কেউ তাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। রাস্তাঘাট, সেতু-টানেল, বিশাল বিশাল ইমারত, বাজারকেন্দ্র থেকে শুরু করে কারও কারও ব্যাংকে জমার অস্বাভাবিক স্ফীতি, বিদেশে পাচার হওয়া বিপুল টাকার অঙ্ককে তুচ্ছ জ্ঞান করা—সবই আমাদের উন্নয়নের সাক্ষ্য দিচ্ছে। কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে আইনের শাসন মেনে চলার মতো সুসভ্য কি আমরা হচ্ছি? অন্য আরও অনেক অধিকার ও দাবির মতো কি এ দেশে স্বাভাবিক মৃত্যুর অধিকারের কথাও আমাদের ভুলে যেতে হবে?
আমাদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার জন্য যাঁরা নিহত হলেন, তাঁদের জন্য গভীর শোক। আর যাঁরা স্বজন হারানোর ব্যথা বুকে চেপে আবার জীবনযাপনের দায় বহন করে চলেছেন, তাঁদের আন্তরিক সমবেদনা।