সাবেক এক সহযোদ্ধার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করতে গিয়ে এ এস এম শাহজাহান বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে সকলকেই একদিন না একদিন চলে যেতে হবে। কিন্তু চলে যাওয়া মানেই ভুলে যাওয়া নয়। কিছু মানুষ তাঁদের কর্মগুণে যুগের পর যুগ, সময়ের পর সময় ধরে বেঁচে থাকবেন।’ যিনি এই শোক প্রকাশ করেছিলেন, তাঁকে নিয়েই এখন আমরা শোক প্রকাশ করছি।
এ এস এম শাহজাহান ৫ ফেব্রুয়ারি ৭৮ বছর বয়সে ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বিপুল কর্মময় জীবনের অধিকারী মানুষটি সামাজিক জাগরণে অবদান রাখতে আমৃত্যু সচেষ্ট ছিলেন। শাহজাহান ও আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৫৮-৬২ পর্বে ছাত্র ছিলাম। আমি বিজ্ঞান অনুষদে ভূগোল বিভাগে, তিনি বাণিজ্য বিভাগে। বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করার প্রায় তিন দশক পর আমরা ‘১৯৫৮-৬২ সতীর্থ সম্মিলন’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তুলি। শাহজাহান আজীবন ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি; অত্যন্ত দক্ষতা ও আন্তরিকতার সঙ্গে তিনি এই সংগঠনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তিনি প্রায় শুরু থেকেই আমাদের বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সঙ্গে সম্পৃক্ত হন এবং একপর্যায়ে বাপার সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনেও তিনি প্রশংসনীয় বলিষ্ঠ নেতৃত্ব দিয়েছেন।
তিনি মাত্র দুবছর বয়সে বাবা–হারা হয়েছিলেন। মায়ের কাছ থেকে তিনি পেয়েছিলেন সৎ থাকা, আদর্শবান মানুষ হয়ে ওঠার দীক্ষা। তাঁর মা বলতেন, সৎ ও সফল মানুষ হতেই হবে তোমাকে। শাহজাহান সেটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিয়েছিলেন। শিক্ষকেরাও তাঁর সহায় ছিলেন। তিনি স্কুলজীবনেই নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ পেয়েছিলেন, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেই মূল্যবোধগুলো পালন করে এসেছেন। জীবনের নানা ধাপে নানা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালনে তিনি এসব নীতি, মূল্যবোধ ও আদর্শে অবিচল থেকেছেন। এর উজ্জ্বল উদাহরণ খুঁজে পাই রাজশাহী ডিগ্রি কলেজ ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে ভূমিকা পালনের সময়ে; ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের প্রথম ডেপুটি কমিশনার ও পরে পুলিশের আইজি এবং সরকারের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শিক্ষা, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে; বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি হিসেবে; সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) জাতীয় কমিটির সদস্য এবং সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময়ে; ঢাকাস্থ ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালনের সময়ে। লক্ষ করি, ইউএনডিপি ঢাকার গভর্ন্যান্স শাখায় জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টার দায়িত্বে নিয়োজিত থাকার সময়ে। এ ছাড়া বাংলাদেশ মেডিকেল, অ্যাপোলো হসপিটালের পরিচালনা পর্ষদের সঙ্গেও যুক্ত থাকার সময়ে আমরা সেই চেতনাবোধের ছাপ দেখতে পাই।
তিনি গণতন্ত্র, উন্নয়ন, সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ একটি কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের কথা ভাবতেন; স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘গণতন্ত্র মানে কিছু লোককে ক্ষমতায়িত করা নয়, বরং সকল জনগণকে ক্ষমতায়িত করা। একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্য জনগণকে শক্তিশালী করা।...আমাদের দেশে আইন আছে, শাসন আছে, কিন্তু আইনের শাসন নেই। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক চর্চা এবং তথ্যের অধিকার নেই। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া দরকার।’
তিনি পরিবেশ রক্ষায় সোচ্চার ছিলেন। তিনি বলতেন, ‘কিছু মানুষের লোভের কারণে আমাদের নদী-জলাধারগুলো আজ ধ্বংসের পথে। পরিবেশ বাঁচাতে এদের হাত থেকে নদী-জলাধারগুলোকে দখল ও দূষণমুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।’ তিনি পরিবেশ বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানাতেন।
তিনি দেশের মানুষকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে তোলার প্রয়োজন বোধ করতেন। তিনি বলতেন, দেশে সৎ ও আলোকিত মানুষের বড়ই অভাব। তাই নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের উন্নত চরিত্র গঠনের প্রতি শিক্ষক ও অভিভাবকদের যত্নবান হতে হবে। কেননা শিক্ষার্থীদের সৎ, চরিত্রবান ও আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে তবেই সমাজ ও রাষ্ট্র আলোকিত হবে। শিক্ষার্থীদের জ্ঞান অর্জনের পাশাপাশি দেশ ও সমাজের প্রতি দায়িত্বশীল হতে হবে। শিক্ষকদের লক্ষ রাখতে হবে যেন তাঁদের মহান পেশার মর্যাদা কোনোভাবে ক্ষুণ্ন না হয়।
এ এস এম শাহজাহানের জীবন থেকে আমাদের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের, অনেক কিছুই নেওয়ার ও শেখার আছে। তিনি তাঁর চিন্তা ও কর্মের মাধ্যমে সমাজের জন্য যে অবদান রেখে গেছেন, উন্নত ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য যে সংগ্রাম ও আন্দোলনসমূহে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন, আমাদের দায়িত্ব হবে সেই আন্দোলন ও সংগ্রামকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। তাহলেই আমরা এ এস এম শাহজাহানের প্রতি যথার্থ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানাব।
আমি তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।
নজরুল ইসলাম নগর গবেষণাকেন্দ্রের চেয়ারম্যান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান