গত মাসে টোকিওতে ব্রেক্সিট–পরবর্তী জাপান-যুক্তরাজ্য সম্পর্ক নিয়ে চ্যাটাম হাউস ও দাইওয়া রিসার্চ ইনস্টিটিউট একটি সম্মেলনের আয়োজন করেছিল। আমি সেখানে যোগ দিয়েছিলাম। প্রায় ছয় বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংক গোল্ডম্যান স্যাকস থেকে বেরিয়ে আসার পর এটিই ছিল আমার প্রথম জাপান সফর। যেহেতু এর আগে ১৯৮৮ সাল থেকেই জাপানে নিয়মিত যাওয়া–আসা করতাম, সেহেতু এত দিন পর সেখানে যাওয়ায় মধ্যবর্তী এই সময়টাতে কতটুকু কী পরিবর্তন হয়েছে, তা আমার চোখে একটু বেশিই ধরা পড়ছিল।
সবখানেই অগ্রগতি আর উন্নয়নের ছোঁয়া দেখছিলাম।
এটা নিশ্চিত যে জাপান এই ২০১৯ সালে উন্নত দেশগুলোর তুলনায় নিজের অবস্থানকে যথেষ্ট স্থিতিশীল জায়গায় নিয়ে এসেছে। এখন থেকে আগামী এক দশক ধরে যদি দেশটি জি-৭ ভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রবৃদ্ধি অর্জন অব্যাহত রাখে, আমি তাতে মোটেও অবাক হব না।
গত দশকে জনসংখ্যার আধিক্যের কারণে জাপানের প্রবৃদ্ধি অর্জন পড়তির দিকে থাকলেও আগামী দশকে সেই চিত্র থাকবে না। এর কারণ হলো জাপানের জনসংখ্যা অত্যন্ত নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় চলে এসেছে। বিদেশি শ্রমিকদের আকৃষ্ট করতে দেশটি ইতিমধ্যেই প্রচার শুরু করেছে। দেশটি স্বীকার করতে শুরু করেছে, ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি অর্জনের স্বার্থে অভিবাসন অত্যন্ত জরুরি বিষয়। আগামী ২০ বছর সেখানে প্রচুর অভিবাসী আসতে দেওয়া হবে বলে মনে করা হচ্ছে। যদিও জাপান দীর্ঘদিন ধরেই অভিবাসনবান্ধব নীতি গ্রহণ করতে অস্বীকার করে এসেছে, তথাপি এখন বোঝা যাচ্ছে, তাদের সেই
নীতি মোটেও বেঠিক ছিল না। ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর দিয়ে সম্প্রতি অভিবাসীর যে চাপ গেছে, সেই পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে জাপানের সিদ্ধান্ত সঠিকই ছিল। তবে এখন জাপান মনে করতে শুরু করেছে, প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্যই অভিবাসীদের আসতে দেওয়া দরকার।
এ বছরের শেষেই শিনজো আবে জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে বেশি দিন দায়িত্বে থাকা প্রধানমন্ত্রীর অভিধা পাবেন। তাঁর আগে জাপানের প্রধানমন্ত্রী পদটি মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো ছিল। শিনজো আবে আসার পরই লক্ষণীয়ভাবে পদটিতে স্থিতিশীলতা আসে। তিনি নিজে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক কৌশল ধরে জাপানকে এগিয়ে নিচ্ছেন। এই কৌশলকে ‘আবেনোমিকস’ নামে ডাকাও শুরু হয়েছে। এই অর্থনীতির হাত ধরে জাপানে প্রবৃদ্ধি বাড়ছে এবং মূল্যস্ফীতি দ্রুত কমতে শুরু করেছে।
জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সরকারি বন্ড এবং অন্যান্য সম্পদ কেনার ২০তম বার্ষিকী ঘনিয়ে আসছে। দেশের অর্থনীতিকে আরও সচল রাখতে ও অর্থ তারল্য বৃদ্ধি করতে কুয়ান্টিটিভ ইজিয়িংয়ের (কিউই) মাধ্যমে জাপানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক (বিওজি) সরকারি সম্পদ ও বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার কেনার নীতি অনুসরণ করে আসছে। মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে রাখতে এবং কোম্পানিগুলোকে তাদের কর্মীদের বেশি বেতন দিতে বাধ্য করতে শিনজো আবে এই নীতি কড়াভাবে অনুসরণ করে আসছেন। বর্তমান অবস্থায় জাপানের কিউই বন্ধ করা যুক্তিযুক্ত হবে না, যদিও অনির্দিষ্টকাল এই নীতি ধরে রাখা নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তুলতে পারেন।
এটি নিশ্চিত যে বিওজি বড় ধরনের মুদ্রাঝুঁকি না নিলে মূল্যস্ফীতি ২ শতাংশের নিচে রাখতে পারত না। অবশ্য এই লক্ষ্য পূরণ হলেই যে কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হবে, সেটি এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। এখন এটি প্রায় নিশ্চিত, আবে যত দিন ক্ষমতায় আছেন, তত দিন বিওজি এই নীতি অনুসরণ করে যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে, বিওজি যখন এসব শেয়ার কেনা বন্ধ করে দেবে, তখন কী হবে?
জাপানের কোম্পানিগুলোর শীর্ষস্থানীয় ১০টি শেয়ারহোল্ডারের মধ্যে বিওজি রয়েছে। বিওজি যদি শেয়ার কেনা বন্ধ করে দেয়, তাহলে শেয়ারবাজার ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সর্বশেষ টোকিও সম্মেলনে গিয়ে সবার কথা শুনে আমি বুঝতে পেরেছি, ব্রেক্সিট–পরবর্তী সময়ে যুক্তরাজ্য-জাপান সহযোগিতা বাড়ানোর যেসব ক্ষেত্রের কথা আমি ভেবেছিলাম, প্রকৃতপক্ষে সেই ক্ষেত্র আরও অনেক বেশি বিস্তৃত।
ইইউ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পর অবধারিতভাবেই যুক্তরাজ্যকে জাপানের সঙ্গে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক বাড়াতে হবে। যুক্তরাজ্যের সঙ্গে আর্থিক সম্পর্কোন্নয়নের সঙ্গে অন্য দেশের সঙ্গেও জাপানের সম্পর্ক বাড়বে। চীনকে মোকাবিলার কৌশলের অংশ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রও জাপানের সঙ্গে শামিল হতে পারে। আগামী জুনে ওসাকায় জি-২০ সম্মেলন হবে। সেখানে ইউরোপীয় দেশগুলোর সঙ্গে জাপানের অর্থনৈতিক সহযোগিতার বিষয়টি বিশদভাবে আলোচনা হবে। ধারণা করা যায়, ওই সময় পশ্চিমাদের সঙ্গে জাপানের সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে। ওই সময় জাপান নতুন রূপে আবার বিশ্বমঞ্চে নিজেকে মেলে ধরার প্রয়াস পাবে।
ইংরেজি থেকে অনূদিত। স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জিম ও’নিল যুক্তরাজ্যের সাবেক অর্থমন্ত্রী