আজ ৯ ফেব্রুয়ারি প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর জন্মবার্ষিকী। বেঁচে থাকলে এই দিনে তিনি ৯৬ পেরোতেন। বাংলাদেশের মানুষ তাঁকে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক অঙ্গনে দেখেছে। তাদের কাছে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ছিলেন প্রতিভাদীপ্ত প্রজ্ঞাবান একজন মানুষ, সর্বপ্রকার জ্ঞান ও মুক্তবুদ্ধির একজন উপাসক, উদার মত ও পথের একজন পথিক এবং নীতির প্রশ্নে সাহসী, আপসহীন একজন পুরুষ। তিনি ছিলেন মননশীল বুদ্ধিজীবীদের অগ্রগণ্য, সভার অলংকার এবং মানবিক আন্দোলনের পুরোধা। লোকে তাঁকে জানত সদা হাস্যময়, শ্রদ্ধা উদ্রেককারী, মিতবাক এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে। কিন্তু এই সবকিছুই অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাইরের পরিচয়। পারিবারিক সূত্রে আমরা যাঁরা তাঁকে ঘরোয়া পরিবেশে দেখেছি, সেখানে তাঁর ভিন্ন রূপ। ঘরের মধ্যে তিনি যে স্বাচ্ছন্দ্যে ঠাট্টা করতে পারতেন ভাইবোনদের সঙ্গে, সেই একইভাবে হাসি-ঠাট্টা করতে পারতেন ভ্রাতুষ্পুত্র, ভ্রাতুষ্পুত্রী, ভগ্নিপুত্র, ভগ্নিপুত্রী ও জামাতাদের সঙ্গে। যে বিষয় নিয়ে তিনি সমবয়সী বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করতেন, সে একই বিষয় নিয়ে তুমুল তর্কে মাততে পারতেন তাঁর দৌহিত্র ও দৌহিত্রীদের সঙ্গে।
পরিবারের বাইরে কজন জানেন যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী যে আগ্রহ নিয়ে শেক্সপিয়ার পড়তেন, সেই একই আগ্রহ নিয়ে পড়তেন দৌহিত্রীদের কাছ থেকে ধার করা কাকাবাবু সমগ্র? বিশ্বনাটকে তাঁর জ্ঞান যতখানি প্রশস্ত ছিল, তার চেয়ে নিতান্ত কম ছিল না তাঁর জানাশোনা হিন্দি চলচ্চিত্রের হালহকিকত সম্পর্কে। বাইরের মানুষ কি জানত যে অধ্যাপক কবীর চৌধুরী ঘণ্টার পর ঘণ্টা টেলিভিশনে ক্রিকেট খেলা দেখতে ভালোবাসতেন? কজনার মনে আছে যে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হকি ব্লু ছিলেন, কে বিশ্বাস করবে যে ঘরের বহু কাজ তিনি নিজ হাতে করতেন? আমি জানি যে তিনি রুটি দেওয়া পুডিং খেতে ভালোবাসতেন, বিশ্বের বিভিন্ন চিত্রশালা ঘোরা আর চিত্রকর্ম দেখা তাঁর নেশা ছিল, আর সামাজিক দেখাশোনার ক্ষেত্রে এক চক্করে ৩০ মিনিটে তিনটি বাড়ি ঘুরে আসতে তিনি প্রাণপণ চেষ্টা করতেন।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর বাইরের পরিচয়ের মতো তাঁর ঘরের পরিচয়টিও তাঁর ব্যক্তিত্বের একটি বড় অংশ। জীবনের বহু বোধ আমরা, তাঁর নিকটজনেরা তাঁর কাছ থেকেই শিখেছি এবং জগতের বহু জ্ঞান তাঁর কাছ থেকেই পাওয়া। আদর্শ মানুষ কাকে বলে, তা আমার জানা নেই, কিন্তু মানুষের আদর্শ বলতে আমরা তাঁকেই বুঝতাম। মানুষের পূর্ণতা সম্পর্কেও আমার ধারণা বড় কম, কিন্তু পূর্ণ মানুষ বলতেও আমরা তাঁর দিকেই তাকাই।
অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর সংবেদনশীলতা ছিল সার্বক্ষণিক, তাঁর স্নেহদৃষ্টি সবার প্রতি সমভাবে বিকশিত ছিল। তিনি মানুষকে সম্মান ও বিশ্বাস করতেন। তিনি জীবনকে ভালোবাসতেন, কিন্তু জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হননি। ক্ষমতার কাছে, অর্থের কাছে, ভীতির কাছে তাঁর স্খলন ঘটেনি। সত্যের প্রতি, বিশ্বাসের প্রতি তিনি অবিচল থেকেছেন এবং নীতির প্রশ্নে কখনো আপস করেননি, এমনকি মৃত্যুর আশঙ্কা থাকলেও। বাংলাদেশের মানুষ এ কথা জানে। তিনটি কথা তিনি প্রায়ই পারিবারিক বলয়ে আমাদের বলতেন। তিনি সব সময়েই বলেছেন, ‘যখন কেউ তোমাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে, তখন বুঝতে চেষ্টা করবে, কেন সে তা করছে। সেটা করলে দেখবে যে আর তোমাদের খারাপ লাগছে না।’ কখনো-সখনো উচ্চারণ করতেন, ‘দুঃখ, কষ্ট, আনন্দ, বেদনায় জীবনের যে অবস্থাতেই থাকো না কেন, সব সময় তা থেকে ভালো দিকটা খুঁজে নেবে।’ সতর্ক করতেন এটা বলে, ‘মানুষের দোষ–গুণ নিয়েই তাদের গ্রহণ করবে, তাদের বিচারে বোসো না।’
নিত্যদিনের গ্লানি ও কালিমার ঊর্ধ্বে উঠতে পেরেছিলেন অধ্যাপক কবীর চৌধুরী। জগতের তুচ্ছতা ও তিক্ততাকে তিনি জয় করতে পেরেছিলেন। নিজেকে কখনো বিক্রি করেননি, অন্যকেও কখনো কিনতে চাননি। কজন মানুষের ক্ষেত্রে এ কথা বলা যায়? নিজে অন্যায় করা থেকে বিরত থেকেছেন এবং সব অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছেন। সত্যিকারের সাহসী মানুষের তো পরিচয় এখানেই। বুদ্ধির মুক্তিতে অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর আস্থা সর্বজনবিদিত। সব গোঁড়ামি আর কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অনলসভাবে সোচ্চার। মুক্তবুদ্ধি আর মুক্তচিন্তা বিষয়ে আমাদের বহু শিক্ষাই তাঁর কাছে পাওয়া।
আমাদের আজকের ‘দুর্বৃত্ত সময়ে’ জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীর মতো ‘সঙ্গী, পার্শ্ব পথচারীর’ বড় প্রয়োজন ছিল। তিনি আজ আমাদের মধ্যে নেই সত্যি, কিন্তু রয়ে গেছে তাঁর লেখা-বক্তব্য, ধ্যানধারণা, আদর্শ-মূল্যবোধ, চিন্তাচেতনা। সেগুলো থেকেই আমরা উদ্দীপ্ত হব, উজ্জীবিত হব, উৎসাহিত হব।
‘পাবে প্রাণ লখিন্দর, ফিরে পাবে বেহুলা সংসার।
মাটির গভীর থেকে শুনি কার বীজকণ্ঠ ওই?
এমন করাল কালে হিন্তালের উচ্চারণ কার?
কবীর চৌধুরী তিনি, তিনি চাঁদ বণিক নিশ্চয়ই।’
(‘হিন্তালের বীজকণ্ঠ কবীর চৌধুরী’
—সৈয়দ শামসুল হক)
ড. সেলিম জাহান জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের পরিচালক