সংসদ নির্বাচন শেষ হওয়ার পর নতুন সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করেছে। বিগত সরকারের সময় ব্যাংকিং খাতের অবস্থা সংকটজনক থাকলেও কোনো রহস্যজনক কারণে সরকার ব্যাংকিং খাতের সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা সত্ত্বেও ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠনের বিষয়টিকে বারবার এড়িয়ে গেছেন। ব্যাংকারদের সঙ্গে আলোচনায় বারবার যে আশঙ্কাটি ব্যক্ত হচ্ছে তা হলো, ব্যাংকিং খাতের অবস্থা ভালো নয়। আওয়ামী লীগের অন্ধভক্ত নেতা-কর্মী ছাড়া দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ একবাক্যে স্বীকার করবেন যে দেশে এখন প্রয়োজনাতিরিক্ত সংখ্যক ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। যেসব বিবেচনায় ২০০৯ সালে মহাজোট ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দফায় দফায় ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে, তাতে অর্থনীতির স্বার্থ কিংবা জনগণের আর্থিক লেনদেনের যুক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ব্যাংকের সেবা পৌঁছে দেওয়ার জন্য নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার চেয়ে বিদ্যমান ব্যাংকগুলোর শাখা বিস্তারকে উৎসাহিত করা হলে অনেক কম ব্যয়ে ওই সুবিধা অর্জন করা যেত। আসলে প্রয়োজনাতিরিক্ত জেনেও নতুন নতুন ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে স্বজনপ্রীতির তাগিদে। বাংলাদেশ ব্যাংকের আপত্তিকে বারবার অগ্রাহ্য করা হয়েছে। এমনকি সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের প্রকাশ্য আপত্তিকেও পাত্তা দেওয়া হয়নি।
ব্যাংকের মালিকানার লাইসেন্স অনেক ভাগ্যবানের জন্য কোটিপতি হওয়ার সহজ পথ করে দিয়েছে। ১৯৯৮ সাল থেকে তিন বছর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক থাকার সময় থেকেই বাংলাদেশের ব্যাংকিং বিষয়ে আমার গবেষণা অব্যাহত রয়েছে। সে জন্যই বেসরকারি খাতের ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের হাঁড়ির খবর আমার জানা আছে। পাঠকদের অনেকেই হয়তো খেয়াল করেন না যে এ দেশের ব্যাংকিং খাতের খেলাপি ঋণ সংকট যত গুরুতরই হোক, দেশের প্রায় প্রতিটি বেসরকারি ব্যাংক প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ মুনাফা করে যাচ্ছে। অতএব ব্যাংকের লাইসেন্স যাঁরা বাগাতে পেরেছেন তাঁরা ওই মুনাফার ভাগ পাওয়ার কারণে এ দেশে অতি সহজেই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যান। সে জন্যই ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’-এর ক্ল্যাসিক নজির হলো ব্যাংকের মালিকানা বণ্টনের এই রাজনৈতিক দুর্নীতি। আর এই ব্যাংক-উদ্যোক্তাদের অনেকেই তাঁদের রাজনৈতিক যোগাযোগের জোরে ব্যাংক প্রতিষ্ঠার লাইসেন্স পেয়ে বিনা মূলধনে অন্য ব্যবসায়ীদের অর্থে তাঁদের ব্যাংকের উদ্যোক্তা-পরিচালক বনে গেছেন। মানে, তাঁর শেয়ারের জন্য বিনিয়োজিত পুঁজিও হয়তো ব্যাংকের অন্য পরিচালকেরা পরিশোধ করে দিয়েছেন। এই পরিচালকদের সিংহভাগ আবার দেশের বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতি, যাঁরা ব্যাংকের মালিকানা পেয়ে এ দেশের ব্যাংকঋণের ওপর একধরনের নিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করে ফেলেছেন। ব্যাংক কোম্পানি আইনে নিজেদের ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার ব্যাপারে তাঁদের ওপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করা হলেও একে অপরের ব্যাংক থেকে দেদার ঋণ গ্রহণের সংস্কৃতি (লোন সোয়াপ) এ দেশে ভয়াবহ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে গেছে।
দেশের কয়েকজন রাঘববোয়াল ব্যবসায়ী বিভিন্ন পন্থায় এসব রাজনৈতিক যোগাযোগওয়ালা ব্যাংক-লাইসেন্সধারীর কাছ থেকে নানা নামে একাধিক ব্যাংকের বিপুল শেয়ার কিনে নেওয়ার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নিজেদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দখলে নিয়ে যাচ্ছেন। চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী নাকি এখন সাতটি ব্যাংকের ওপর মালিকানা প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন! ব্যাংকগুলোর ঋণ নিয়ে ওই ব্যবসায়ী নয়ছয় করছেন বলে ব্যাংকারদের কাছ থেকে অভিযোগ পাওয়া গেছে, বেনামি ঋণে নাকি সয়লাব হয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। একজন ব্যক্তিকে এতগুলো ব্যাংকের ওপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে দিয়ে পুরো ব্যাংকিং খাতকে বড়সড় ঝুঁকিতে ফেলে দেওয়া হয়েছে বলে ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞদের অভিমত। দেশের ‘কমপিটিশন অ্যাক্ট’ বা প্রতিযোগিতা আইন তো এ ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা! ব্যাংকের মালিকানায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এত সহজ সুযোগ অন্য কোনো দেশে চালু আছে কি না, আমার জানা নেই। এ ব্যক্তির খামখেয়ালিপনায় আর্থিক খাতে ভবিষ্যতে ধস নামলে কিংবা ব্যাংকিং খাত কোনো মহলের ‘ব্ল্যাকমেল’-এর শিকার হলে অবাক হব না আমি।
প্রকৃত প্রস্তাবে ব্যাংকের এসব মালিকের অভিহিত করা উচিত ‘কথিত মালিক’, কারণ ব্যাংকের আসল মালিক আমানতকারীরা। ব্যাংকের উদ্যোক্তারা কিংবা পরিচালকেরা এমনকি শেয়ারহোল্ডাররা ব্যাংকের ‘প্রকৃত মালিক’ নন। কারণ একেকটি ব্যাংক যে হাজার হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ করে ঋণ প্রদানের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে তার তুলনায় সম্মিলিতভাবে ওই তিন ধরনের মালিকদের বিনিয়োজিত পুঁজি ১০ শতাংশের বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। একটি আধুনিক অর্থনীতির সুস্বাস্থ্যের জন্য সুস্থ ও সবল ব্যাংকিং ব্যবস্থা যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, সেটা ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দার পর এখন বিশ্ববাসীর জানা হয়ে গেছে। বিশেষত, আমাদের দেশে পুঁজিবাজার যেহেতু একেবারেই অনুন্নত এবং গুরুত্বহীন রয়ে গেছে তাই ব্যাংকিংকে এ দেশে এখনো স্বল্পমেয়াদি ঋণের পাশাপাশি মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের প্রধান জোগানদাতার ভূমিকাও পালন করে যেতে হচ্ছে। দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির যে সুবাতাস বইতে শুরু করেছে, সেটাকে বেগবান করতে হলে জাতীয় সঞ্চয়কে উৎপাদনশীল বিনিয়োগে রূপান্তরিত করার প্রক্রিয়াকে আরও জোরদার করতেই হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন সবল ও স্বচ্ছ ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে আরও বেশি শৃঙ্খলাধীন ও সুনিয়ন্ত্রিত করার প্রক্রিয়াকে জোরদার করা।
নতুন নতুন ব্যাংক চালু হওয়ায় এখন আমানত নিয়ে যে অসুস্থ কাড়াকাড়ি পরিদৃষ্ট হচ্ছে, তার ফলে ব্যাংকাররা মরিয়া হয়ে নানা ফন্দি-ফিকিরের আশ্রয় নিচ্ছেন, যা ব্যাংকিং খাতের পরিবেশ দূষিত করে চলেছে। আমানত সংগ্রহের প্রতিযোগিতার ফলে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন ব্যাংক আমানতের ওপর ৯ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে যাচ্ছে বলে গত ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখের পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। যার ফলে ব্যাংকঋণের সুদের হার বাড়ানোর জন্য পুরো ব্যাংকিং খাতে আবার প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়েছে। ঋণের ওপর ‘সিঙ্গেল ডিজিট’ সুদের হার কি তাহলে শুধুই ‘নির্বাচনী স্টান্ট’ ছিল? এভাবে ঋণের সুদ বাড়তে থাকলে বিনিয়োগে ভাটার টান লাগতে দেরি হবে না। অনেকগুলো বেসরকারি ব্যাংক সম্প্রতি কঠিন তারল্য–সংকটে নিপতিত হয়ে রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলো থেকে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এ রকম তারল্য–সংকট যদি পুরো ব্যাংকিং খাতে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে আর্থিক খাত চরম সংকটের সম্মুখীন হতে পারে।
ওপরের আলোচনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, প্রয়োজনাতিরিক্ত সংখ্যক ব্যাংক চালু করে যেসব নেতিবাচক অভিঘাত ডেকে আনা হয়েছে, সেগুলো নিরসনের একটা পথ খুলে দিতে পারে অদূর ভবিষ্যতে বেশ কিছু দুর্বল ব্যাংককে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কয়েকটি ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত করার আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপটি হতে পারে রাষ্ট্রমালিকানাধীন কয়েকটি ব্যাংককে ‘মার্জারের’ মাধ্যমে বড় ব্যাংকগুলোর সঙ্গে একীভূত করার ব্যবস্থা করা। সোনালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক এবং অগ্রণী ব্যাংকের সঙ্গে অন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোকে একীভূত করলে তেমন কোনো নেতিবাচক অভিঘাতের সৃষ্টি হবে বলে মনে হয় না। এমনকি বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকেরও আলাদা অস্তিত্বের প্রয়োজন এখন আছে কি না, ভেবে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংককে একীভূত করে একটি ব্যাংকে পরিণত করলেও তেমন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। অন্যদিকে দেশে এতগুলো ‘ইসলামি ব্যাংকের’ আবশ্যকতা নেই।
ফারমার্স ব্যাংককে পদ্মা ব্যাংক করলে কি আমানতকারীদের আস্থা ফিরে আসবে? আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, বড় উদ্যোক্তাদের উৎসাহী করতে হবে পুঁজির জন্য শেয়ারবাজারে যেতে। পুঁজিবাজারের দুর্বলতার জন্য এত দিন ধরে দীর্ঘমেয়াদি বড়সড় ঋণের জন্য যেভাবে ব্যাংকিং খাতকে বিকল্প পুঁজির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে, তা থেকে আমাদের সরে আসতেই হবে। নইলে খেলাপি ঋণের সমস্যা থেকে দেশ পরিত্রাণ পাবে না। ব্যাংকিং খাত থেকে খুব বড় ঋণ এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়া ক্রমেই বন্ধ করে দিতে হবে। এমনকি ব্যাংকঋণের পরিমাণের ওপর ‘সর্বোচ্চ সিলিং’ আরোপের চিন্তাভাবনা করার সময় এসেছে মনে করি। আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা পুঁজির জন্য এখনো পুঁজিবাজারে যেতে বড়ই অনাগ্রহী রয়ে গেছে। একই কারণে, এ দেশের ৯৫ শতাংশ শিল্প-বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান পারিবারিক গণ্ডিতে গড়ে ওঠা ‘প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি’ থাকতেই বেশি পছন্দ করে, ‘পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি’ হলে যে নিয়ম-নীতির আওতায় আসতে হবে সেগুলো এড়াতে চায় বেশির ভাগ শিল্পপতি-ব্যবসায়ী। কিন্তু ব্যাংকিং খাতকে যত দিন আমরা দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিতে বাধ্য করব, তত দিন ব্যাংকগুলো খেলাপি ঋণ সমস্যা থেকে মুক্তি পাবে না। অতএব এই সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে আমাদের।
এই কলাম লেখার পর্যায়েই খবর বেরিয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক মন্দঋণ ‘রাইট-অফ’ করার নীতি অনেকখানি শিথিল করেছে। এই পরিবর্তনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো, বাংলাদেশ ব্যাংকের আগামীবারের ক্লাসিফায়েড লোনের পরিমাণ ঘোষণার আগে ওই পরিমাণ কম দেখানোর ব্যবস্থা করা। কিন্তু এ ধরনের পরিবর্তন সমস্যাটিকে আড়াল করার পন্থা হলেও মন্দঋণ আদায় করার কোনো নিষ্ঠাবান প্রয়াস এর মাধ্যমে জোরদার করার লক্ষণ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ সময়ের দাবি হলো খেলাপি ঋণ আদায়ে সরকারের সত্যিকার সদিচ্ছার, ঋণখেলাপিদের প্রতি ‘জিরো টলারেন্স’। এ জন্য পথ দেখানোর প্রয়োজনে অবিলম্বে একটি শক্তিশালী ব্যাংকিং সংস্কার কমিশন গঠন করার আহ্বান জানাচ্ছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে।
অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
আরও পড়ুন...