অমর একুশে গ্রন্থমেলার এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে এক অতিথি হিসেবে আপনারা আমাকে আহ্বান করেছেন আজ। আমি সম্মানিত।
মেঘনা নদীর কূলে চাঁদপুর আমার জন্মভূমি। সন্ধ্যা নদীর কূলে বানারীপাড়ায় আমার পিতৃপিতামহের ভিটে, কীর্তনখোলা নদীর ধারে বরিশাল শহরে লালিত হয়েছি আমি সাড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত। আর গোটা স্কুলজীবনটা আমার কেটেছে পদ্মা নদীর পারে হার্ডিঞ্জ ব্রিজসংলগ্ন পাকশী নামের এক আশ্চর্য কলোনিতে।
১৫ বছর বয়সের পর জীবনে আরও ৭২ বছর আমার কাটল গঙ্গার কূলে যে কলকাতা শহরে—সেখান থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকায় এসেছি আমি, আপনাদের আহূত এক অতিথি হিসেবে। সম্মানবোধ করছি আমি তাই, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা সংকোচেও ছেয়ে যাচ্ছে মন। যে দেশের হাওয়ায় মাটিতে জলে গোটা কৈশোর কেটেছে, সেই দেশই তো আমার। ৭২ বছর ধরে প্রায় প্রতিমুহূর্তে সেই ১৫ বছরকেই তো ধারণ করে আছি আমি। তাই এটা আমারও দেশ। এখানে কি আমার অতিথি হয়ে আসা সাজে? বহুবার এসেছি আমি বাংলাদেশে, কিন্তু বহুবার এড়িয়ে গিয়েছি এখানকার নানা আনুষ্ঠানিক আহ্বান। এবারে স্বরের আর শরীরের জীর্ণতা সত্ত্বেও এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে মনে হলো আমার জীবনে এ এক নতুন অভিজ্ঞতা।
সংকোচবশত হলেও আমি আজ আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। কৃতজ্ঞতা জানাই সেই একুশের স্মৃতিকে, যার মধ্য দিয়ে আমাদের প্রিয় বাংলা ভাষার এত দূর বিশ্বজনীন মর্যাদা আজ। ১৯১৩ সালের বিশ্বসাহিত্য জগতে রবীন্দ্রনাথের আবির্ভাব, ১৯৫২ সালে ঢাকা শহরে একুশে আন্দোলন, ১৯৭১-এ নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের জন্ম আর ১৯৯৯ সালে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে সেই একুশে ফেব্রুয়ারিকে বিশ্বজগতের স্বীকৃতি—আমার কাছে, আর আশা করি, আরও অনেকেরই কাছে এই চারটি মুহূর্ত হলো আমাদের ভাষার জন্য এক জয়গর্বের মুহূর্ত।
সেই গর্ব নিয়ে আজ উচ্চারণ করতে চাই, পঞ্চাশের দশকে লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি উচ্চারণ, ‘ওপারে যে বাংলাদেশ/ এপারেও সে বাংলা।’ শুধু ঢাকায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলছি বলে লাইনটা একটু ঘুরিয়ে নিতে চাই। এপারে যে বাংলাদেশ ওপারেও সেই বাংলা।
একটি কথা ভেবে বিস্মিত হই মাঝেমধ্যে যে কত আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এই ‘বাংলাদেশ’ নামটি। সেই বাংলাদেশের সমস্ত স্বপ্ন সফল হয়ে উঠবে একদিন, এই পরম প্রত্যাশা নিয়ে আজ এই গ্রন্থমেলার উদ্বোধন হোক। আপনাদের সবাইকে আমার ভালোবাসা, নমস্কার।
(১ ফেব্রুয়ারি একুশে গ্রন্থমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্য)
শঙ্খ ঘোষ ভারতের বাঙালি কবি