সম্প্রতি একটি দৈনিক পত্রিকায় পরপর দুটি রাস্তার কাহিনি পড়ে মনটা দোটানায় পড়ে গেল! ২২ জানুয়ারির দৈনিক সমকাল-এ ‘স্বেচ্ছাশ্রমে ১০ কিলোমিটার রাস্তা’ শিরোনামটি দেখে চোখ সেখানেই আটকে গেল। সংবাদের মূল প্রতিবেদনটি পড়ার আগে আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল, এটি পার্বত্য চট্টগ্রামের নিউজ হতে পারে! এমনটা মনে হওয়ার বিশেষ কারণ হলো, আমি ছোটকাল থেকেই আমাদের চারপাশে এভাবে স্বেচ্ছাশ্রমে যৌথভাবে কাজ করার রীতি দেখে এসেছি। কথাটা শুনতে ‘বাহুল্য’ মনে হতে পারে, কিন্তু পাহাড়ি সমাজে এই যৌথতা কালে কালে চলে আসছে। যেমন যৌথভাবে বন সংরক্ষণ করা, সরকারি রাস্তা বা চলাচলের রাস্তা ভেঙে গেলে কিংবা ঝোপঝাড়ে ঢেকে গেলে সেসব পরিষ্কার করা ও মেরামত করা, পাড়ার স্কুলের আশপাশের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করা, যাতে বাচ্চারা নিরাপদে স্কুলে আসা-যাওয়া করতে পারে, এলাকার মন্দির মেরামত করা কিংবা কখনো দেখা গেল বর্ষা মৌসুম প্রায় শেষ, কিন্তু কোনো চাষি ধান রোপণ শেষ করতে পারেননি, তখন গ্রামের সবাই একদিন ওই চাষির জমিতে স্বেচ্ছাশ্রমে ধান রোপণ করে দিয়ে এল—এসব যৌথ কাজগুলো শৈশব থেকেই দেখেছি বলে তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের কথা প্রথম মনে এসেছে। এখানে আরেকটি কথা উল্লেখ করতেই হয় যে পাহাড়ে বহুকাল যাবৎ একটি রীতি প্রচলিত আছে, তা হলো গো পথ অর্থাৎ জঙ্গলে গরু চলাচলের রাস্তা কখনো বন্ধ করা হয় না। এ প্রসঙ্গে পরে আসছি।
হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম স্বেচ্ছাশ্রমে ১০ কিলোমিটার রাস্তাটি রাঙামাটির বরকল উপজেলার সীমান্তবর্তী দুর্গম এলাকার ১০ গ্রামের মানুষ মিলে তৈরি করেছে। বর্তমানে দেশে উন্নয়নের জোয়ার চললেও সেই জোয়ারের ধাক্কা সেখানে পৌঁছায়নি। তাই তারা নিজেদের প্রয়োজনেই জোটবদ্ধ হয়ে এ কাজটি করে দেখিয়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী আইমাছড়া ইউনিয়নের মদনপাড়া, কৃষ্ণপাড়া, সাইচালপাড়া, দোজরিপাড়া, ভধাপাড়া, দীঘনছড়িপাড়া, করল্যাছড়িপাড়া, নোয়াপাড়া, আইমাছড়া মুখপাড়া ও জগন্নাথছড়া গ্রামের মানুষেরা দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখে আসছিল, তাদের একটি রাস্তা হবে! সে রাস্তা দিয়ে তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে! তাদের উৎপাদিত পণ্য সহজে বাজারে নিয়ে গিয়ে সওদা করতে পারবে! প্রতি পরিবার থেকে একজন করে প্রতি সপ্তাহে দু-তিন দিন শ্রম দিয়ে ১০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করে তারা এ অনন্য নজির সৃষ্টি করেছে। স্বেচ্ছাশ্রমে এ রাস্তা তৈরি করে ১০ গ্রামের মানুষ স্থানীয় প্রশাসন ও স্থানীয় প্রকৌশল বিভাগকে যেন চোখে আঙুল দিয়ে তাদের ব্যর্থতাকে দেখিয়ে দিল! দেখা যাক এবার স্থানীয় প্রকৌশল দপ্তরের কতটুকু টনক নড়ে। গ্রামবাসী মাটি কেটে রাস্তা করেছে ঠিকই কিন্তু তাদের পক্ষে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করা সম্ভব নয়। এ জন্য স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরকেই অগ্রণী ভূমিকা নিতে হবে।
২.
উল্লিখিত সুন্দর নজিরের খবরটি পড়ার পরের দিনই আবার একই দৈনিকে আরেকটি খবরে চোখ আটকে গেল। বান্দরবানের জেলা প্রশাসন মেঘলা পর্যটনের দ্বিতীয় গেটটি বন্ধ এবং গেটের পাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে স্থানীয় দুটি তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার প্রায় ৫০টি পরিবারের লোকজনের চলাচলের একমাত্র পথটি বন্ধ করে দিয়েছে! কী বিচিত্র আমাদের এ দেশ! দেশের সেবা, জনগণের সেবার জন্যই এ রাষ্ট্র, এ সরকার, প্রশাসন। আমরা দু পয়সা রোজগার করে সেখান থেকেই সরকারকে কর দিচ্ছি, যাতে এ রাষ্ট্র আমাদের মতো সাধারণ মানুষের ন্যূনতম সুবিধাগুলো নিশ্চিত করতে পারে। আর বান্দরবানের জেলা প্রশাসন দুটি পাড়ার মানুষের, স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের একমাত্র পথটি বন্ধ করে দিয়ে সময়মাফিক খোলা-বন্ধ রাখার নিয়ম জারি করেছে! এ যেন রাজধানীর দাপুটে বাড়িওয়ালা কর্তৃক ভাড়াটেকে নির্দিষ্ট সময় দুবেলা পানি সরবরাহের নিয়ম! মানুষের দৈনন্দিন প্রয়োজন ও জরুরি মুহূর্ত যেকোনো সময় যেকোনোভাবে আসতে পারে। কোনোরূপ বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ না করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই দুটি পাড়ার একমাত্র চলাচলের রাস্তাটি বন্ধ করে দিয়ে প্রশাসন পরোক্ষ এই গ্রামবাসীর সেখান থেকে অন্যত্র সরে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে কি না, অনেকের মনে সেই প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। লালমোহন তঞ্চঙ্গ্যা পাড়ার কার্বারি জানান, গ্রামের লোকেরা এ চলাচলের পথটি দীর্ঘ ৪০ বছর ধরে ব্যবহার করছে। শুধু পর্যটনের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য দুটি গ্রামের মানুষের সুবিধা-অসুবিধাকে তোয়াক্কা না করে মেঘলার এই দ্বিতীয় গেট নির্মাণ করা হয়েছে। এ গেট নির্মাণের সময় বলা হয়েছে, পাড়ার লোকদের চলাচলে কোনো বাধা সৃষ্টি করা হবে না।
সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্পের বিকাশ ও সম্ভাবনার কথা প্রায়ই বলে থাকে। কিন্তু আমাদের কথা হচ্ছে, পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটাতে কেন সেখানকার আদি বাসিন্দাদের উচ্ছেদ করে পর্যটনশিল্প গড়ে তুলতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পর্যটনশিল্প বিকাশের উদ্দেশ্য শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নয়, বরং সেখানে বসবাসরত জাতিসত্তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো, পার্বত্য চট্টগ্রামে যেখানে পর্যটনের বিকাশ ঘটেছে, সেখান থেকে স্থানীয় অধিবাসীদের উচ্ছেদ হতে হয়েছে এবং যারা রয়ে গেছে তারাও যেকোনো সময় উচ্ছেদ হবে। যেমন সাজেক ভ্যালির পর্যটনের কথাই ধরি। সাজেকের অপার সৌন্দর্যে সেখানে আসা পর্যটকেরা মুগ্ধ হয়ে একরাশ আনন্দ নিয়ে বাড়ি ফিরে যান! কিন্তু তাঁদের মনে কখনো কি উচ্ছেদ হওয়া সেখানকার অধিবাসীদের বেদনার কথা উপলব্ধিতে এসেছে!
আওয়ামী লীগ একাদশ সংসদে বিপুল জয় নিয়ে টানা তৃতীয়বারের মতো ÿক্ষমতায় এসেছে। তারা বলছে উন্নয়ন অব্যাহত রাখতে এ সরকার কাজ করে যাবে। কিন্তু আমরা যখন দেখি পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি রাস্তার জন্য ১০ গ্রামের মানুষ স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটে রাস্তা বানাতে বাধ্য হচ্ছে! পর্যটনের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য গেট বন্ধ রেখে স্থানীয় অধিবাসীদের একমাত্র চলাচলের পথ বন্ধ হয়ে যায়! তখন সত্যিই গলা ফাটিয়ে বলতে ইচ্ছে হয়, এমন উন্নয়ন চাই না—যে উন্নয়ন আমার স্বাধীন চলাফেরা থামিয়ে দেয়! এমন উন্নয়ন চাই না—যে উন্নয়ন আমাকে আমার ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করে!
তাই সবশেষে বলতে হয়, যে উন্নয়ন আমার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে, সেই উন্নয়ন দিয়ে আমরা কী করব। বরং আমাকে আমার মতো
থাকতে দাও।
ইলিরা দেওয়ান হিল উইমেন্স ফেডারেশনের সাবেক সাধারণ সম্পাদক