ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ অনুষদে স্নাতকোত্তর শ্রেণির নৈশ কোর্সের ছাত্র ওয়ালিদ আশরাফের কথা কি মনে আছে? ২০১৭ সালের ডিসেম্বর এবং গত বছরের এপ্রিলে পরপর দুবার ডাকসুর নির্বাচনের দাবিতে তিনি একাই অনশনে বসেছিলেন। ক্যাম্পাসে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টার অভিযোগে তাঁকে লাঞ্ছিত করা হয়েছিল। তবু তাঁর সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। তাঁর দুই দফা অনশনের মাঝখানে গত বছরের জানুয়ারিতে একই দাবিতে বামপন্থী ছাত্রসংগঠনগুলো ঘেরাও কর্মসূচি দিলে নির্লজ্জভাবে তাদের ওপর হামলা করা হয়েছিল। ছাত্র-ছাত্রীরা কার্যালয় ঘেরাও করায় অবরুদ্ধ উপাচার্য ছাত্রলীগের নেতাদের ফোন করে তাঁকে উদ্ধারের অনুরোধ জানানোর মতো নজিরবিহীন পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। ডাকসু নির্বাচনের জন্য ছাত্র-ছাত্রীদের আরেকটি অংশ আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু আদালতের নির্দেশিত সময়ের মধ্যে নির্বাচন আয়োজনে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যে মোটেও আগ্রহী ছিল না, তা বোঝা যায় আদালতের বেঁধে দেওয়ার সময়ের মধ্যে ভোটের আয়োজন না করায়। আদালতের নির্দেশ মেনে চললে ডাকসুর নির্বাচনটি গত বছরের প্রথমার্ধেই সম্পন্ন হয়ে যেত। তবে, অতীতে নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখার জন্য তারা যতটা তৎপর ছিল, এখন যেকোনোভাবেই হোক একটা নির্বাচন আয়োজনে তারা তার চেয়ে অনেক বেশি সচেষ্ট। কারণটা অবশ্য বুঝতে কারও কষ্ট হওয়ার কথা নয়। আগে সরকার চায়নি আর এখন সরকার চাইছে।
বিশ্বজুড়েই বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তচিন্তা ও মুক্তবুদ্ধি চর্চার তীর্থকেন্দ্র। তবে ব্যতিক্রমও আছে এবং প্রধানত তা সেইসব দেশে, যেখানে গণতন্ত্র নেই অথবা গণতন্ত্র দুর্দশাগ্রস্ত। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের দেশে এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান বিচার করা হচ্ছে জ্ঞান অন্বেষণ বা সৃজনশীলতায় শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের বদলে চা-শিঙাড়ার দামে। সামরিক শাসনের আমলেও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো মুক্তচিন্তার চর্চায় প্রাণবন্ত ছিল, শিক্ষার্থীরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল, শিক্ষকেরা ছিলেন অভিভাবক। কিন্তু গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর ধীরে ধীরে বহুমাত্রিকতার ইতি টানা হয়েছে, বিতর্কের পথ রুদ্ধ হয়েছে, একমুখিনতা প্রতিষ্ঠা হয়েছে এবং শিক্ষকদের একটা বড় অংশ আর অভিভাবক নেই বরং প্রশাসক ও নিয়ন্ত্রকের ভূমিকাই বেছে নিয়েছেন। সামরিক শাসককে ‘বিশ্ববেহায়া’ বলার স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু এখন কথিত কটূক্তির অভিযোগে মারধর করে পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এ রকম অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আয়োজিত হচ্ছে ডাকসু নির্বাচন।
২৮ বছর পর ছাত্র–ছাত্রীদের গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাকে নিঃসন্দেহে স্বাগত জানানো উচিত। ডাকসু ভবনে জমে থাকা ২৮ বছরের জঞ্জাল পরিষ্কারের ছবিগুলো আমাদের অনেককেই আশাবাদী করেছে। কেননা, ওই সব জঞ্জাল শুধু আক্ষরিক অর্থে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সুবিধাবাদিতা, আপসকামিতা, রাজনৈতিক চাটুকারিতার জঞ্জাল জমেছে, সেগুলোর প্রতীকও বটে।
কিন্তু যেভাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে, তাতে তেমন একটা আশাবাদী হওয়ার সুযোগ কই? বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের শীর্ষে আছেন উপাচার্য, যিনি ডাকসুরও সভাপতি। কিন্তু বর্তমান উপাচার্য নিজেই তো বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের শর্ত অনুযায়ী নিয়মিত নন, তথা নির্বাচিত নন। অধ্যাপক মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান উপাচার্য পদে সাময়িকভাবে দায়িত্ব পেয়েছিলেন ২০১৭ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। কিন্তু ১৫ মাসেও তাঁকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের স্বাভাবিক প্রক্রিয়াটি পূরণ করা হয়নি। আইন অনুযায়ী সিনেট সদস্যরা ভোট দিয়ে তিনজনের একটি প্যানেল নির্বাচন করেন, যাঁদের মধ্য থেকে রাষ্ট্রপতি একজনকে চার বছর মেয়াদের জন্য উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেবেন। সিনেট গঠন নিয়ে যে বিরোধ ছিল, আদালতে তার নিষ্পত্তি হয়েছে তাঁর সাময়িক নিয়োগের আগেই। তাহলে কেন সিনেটে উপাচার্য প্যানেল নির্বাচনের ব্যবস্থাটি এত দিনেও সম্পন্ন হলো না? ডাকসু গঠনের আগে তাহলে সভাপতি পদের নির্বাচনটি কেন সম্পন্ন করা হবে না? ডাকসুর নির্বাচনের তুলনায় উপাচার্য প্যানেলের নির্বাচন তো সামান্য আয়োজন মাত্র!
সাময়িক নিয়োগ থেকে স্থায়ী বা নির্দিষ্ট মেয়াদের নিয়মমাফিক নিয়োগের আশায় সরকারের মুখাপেক্ষী থাকা অবস্থায় কারও পক্ষে স্বাধীনভাবে কাজ করা কি আদৌ সম্ভব? সাম্প্রতিক কালের বিভিন্ন ঘটনাতেও বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারের স্বাধীন এবং নিরপেক্ষ অভিভাবকের ভূমিকার কোনো প্রমাণ মেলে না। ছাত্র-তরুণদের কোটা সংস্কারের আন্দোলনের সময় বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে আন্দোলনকারীদের ওপর বারবার হামলার ঘটনা ঘটলেও তিনি তাঁদের সুরক্ষায় এগিয়ে আসেননি। বরং তিনি কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীদের তালেবানের সঙ্গে তুলনা করেছেন (ডিইউ ভিসি রিলেটস কোটা রিফর্মিস্ট টু তালেবান, ডেইলি স্টার অনলাইন, ৮ জুলাই, ২০১৮)। তিনি বলেছেন, জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো যেভাবে শেষ অস্ত্র হিসেবে নারীদের ব্যবহার করে থাকে, কোটা সংস্কারের আন্দোলনকারীরা ছাত্রীদের নিয়ে সেটাই করছেন।
বিএনপির শাসনামলে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো যেমন ছাত্রলীগমুক্ত ছিল, বলা যায় সেই ধারাবাহিকতাতেই গত ১০ বছর ক্যাম্পাস ছাত্রদলমুক্ত আছে। তবে ছাত্রাবাসগুলোতে সরকার–সমর্থক ছাত্রসংগঠনের নিয়ন্ত্রণ নিরঙ্কুশ করতে গেস্টরুম কালচার নামক এক অভিনব নতুন পদ্ধতির সংযোজনও ঘটেছে। ২০১৬ সালের গোড়ার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ হলের অর্থনীতি বিভাগের প্রথম বর্ষের ছাত্র হাফিজুর মোল্লার মৃত্যুর কথা হয়তো অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন। হাফিজুরের মৃত্যুতেও সেটি বন্ধ হয়নি। বরং তাঁর অস্তিত্ব স্বীকার করে নিয়ে প্রভোস্টরা বিষয়টি সম্পর্কে সতর্ক থাকবেন বলে মন্তব্য করেছিলেন সূর্য সেন হলের তখনকার প্রভোস্ট অধ্যাপক মাকসুদ কামাল, যিনি শিক্ষক সমিতির বর্তমান সভাপতি (গেস্টরুম কালচারের নামে ছাত্রলীগের আদালত, সমকাল, ৫ নভেম্বর, ২০১৬)। যাঁরা কোনো দল করেন না কিন্তু কোটা সংস্কারের আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তাঁদেরও যখন বেছে বেছে হলগুলো থেকে উচ্ছেদ করা হয়, তখন প্রশাসন তাঁদের রক্ষায় এগিয়ে আসেনি।
নির্বাচন ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে তাই দাবি উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ে সব দল-মতের অনুসারীদের সহাবস্থান ও সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। আর, এগুলো যে শিগগির ছাত্রাবাসগুলোতে ছাত্রলীগের সৃষ্ট ভয়ের পরিবেশ দূর করতে পারবে না, সেই উপলব্ধি থেকে একাডেমিক ভবনগুলোতে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করার দাবি উঠেছে। কিন্তু উপাচার্য এগুলো গ্রহণে রাজি হননি এবং যথারীতি সিন্ডিকেটে সেগুলো প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। একাডেমিক ভবনের বদলে হলে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থার প্রতি আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের সমর্থন অন্যদের সন্দেহ আরও বাড়িয়ে দেয়। জাতীয় নির্বাচনের সময় যেমন সরকার এবং নির্বাচন কমিশন ‘স্বাভাবিক পরিবেশ’ বজায় থাকার কথা শুনিয়েছে, ঠিক তেমনই বাণী শোনাচ্ছেন উপাচার্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ এতটাই স্বাভাবিক ও শান্তিপূর্ণ যে কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতাদের ওপর বাংলা একাডেমিতেও হামলার শিকার হতে হয়েছে। অথচ ওই একটি ঘটনার কারণেই সিন্ডিকেটে ভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত হওয়ার কথা। পরিবেশ স্বাভাবিক করা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। অন্যদিকে কর্তৃপক্ষের পক্ষপাতমুক্ত হওয়ার চেষ্টা আন্তরিক এবং তা বিশ্বাসযোগ্য হওয়া জরুরি। এসব অস্বীকার করে সবার আস্থা অর্জন কি সম্ভব?
বিশ্ববিদ্যালয়ের সব নিয়মিত ছাত্র-ছাত্রীর ভোট দেওয়ার এবং প্রার্থী হওয়ার সুযোগ রাখার জন্য ছাত্রসংগঠনগুলো সুপারিশ করেছিল এবং ডাকসু সনদ সংশোধনের জন্য উপাচার্য যে পাঁচ সদস্যের কমিটি করেছিলেন, সেই কমিটিও তাতে সম্মত ছিল। কিন্তু সিন্ডিকেট সভার আগে ওই সুপারিশটি বদলে দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ৩০ বছরের বয়সসীমা বেঁধে দেওয়া হয় (ডাকসু ইলেকশন: ভিসি টু রিমেইন অল পাওয়ারফুল, ডেইলি স্টার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯)। এই পটভূমিতে কর্তৃপক্ষের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা মোটেও অস্বাভাবিক নয়।
নব্বইয়ের গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের পর রাজনৈতিক দলগুলো পালাক্রমে ক্ষমতায় এলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের বিষয়ে তাদের মনোভাব ছিল নেতিবাচক। সরকারবিরোধী ছাত্রসংগঠন বিজয়ী হলে তারা সময়ে-অসময়ে সরকারের অস্বস্তির কারণ হতে পারে, এই আশঙ্কাই ছিল তার মূল কারণ। এখন প্রায় তিন যুগ পর জাতীয় নির্বাচনের মতোই দলীয় সরকারের সময়ে ডাকসু নির্বাচন হতে যাচ্ছে। কিন্তু দেশের শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এই নির্বাচনও বিশ্বাসযোগ্যতার সংকটে পড়ুক, তা কারওই কাম্য হতে পারে না। ২৮ বছরের অপেক্ষা আরও কয়েক মাস বা সপ্তাহের জন্য দীর্ঘায়িত হওয়ার চেয়ে নির্বাচনী প্রহসনের ক্ষতি এবং বিপদ অনেক বেশি।
কামাল আহমেদ সাংবাদিক