গত ২৫ জানুয়ারিসংঘটিত কুমিল্লার সড়ক দুর্ঘটনাটি আমাদের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতার এক ভয়াবহ নিষ্ঠুর চিত্র তুলে ধরেছে।
সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের মৃত্যু কিংবা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে মহাসড়কে মানুষ হত্যা বাংলাদেশে নতুন নয়। একজন সাবেক মন্ত্রী বলেছিলেন, চালকদের বেশি লেখাপড়া করার প্রয়োজন নেই। গরু-ছাগল চিনলেই চলে। তাই ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে ১৩ জনের মৃত্যুর ঘটনায় আমরা অবাক হই না। ব্যথিত হই।
গত ২৮ জানুয়ারি কেরানীগঞ্জের কসমোপলিটন স্কুলের সহোদর দুই শিক্ষার্থী ট্রাকচাপায় নিহত হওয়ার প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছে তাদের সহপাঠী, অভিভাবকসহ হাজার হাজার মানুষ। গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে দুই কলেজশিক্ষার্থী মারা যাওয়ার পর নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল কিশোর-তরুণেরা। তাতেও সড়কে মৃত্যুর মিছিল থামেনি। যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা গেছে ৭ হাজার ২২১ জন। দুর্ঘটনায় একজন মানুষের মৃত্যু মানে পুরো পরিবারের সারা জীবনের কান্না।
কিন্তু কুমিল্লায় ইটখোলায় ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে যে ১৩ জন মানুষ মারা গেছে, তাদের পরিচয় জেনে আমরা আঁতকে উঠেছি। নিহত ১৩ শ্রমিকের মধ্যে ১০ জনই ছিল স্কুলছাত্র। তাদের বাড়ি নীলফামারী জেলার জলঢাকা উপজেলায়। এই বয়সেই দারিদ্র্য তাদের ঠেলে দিয়েছিল ইটভাটার কাজে। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, নিহত ১০ শিক্ষার্থীর মধ্যে ৫ জন পড়ত মীরগঞ্জ হাট বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। অপর ৫ জন পাশের দুটি বিদ্যালয়ের ছাত্র। বয়স ১৫ থেকে ১৯ বছরের মধ্যে। সবাই ছিল দশম শ্রেণির ছাত্র। এটিকে দুর্ঘটনা বলা যাবে না। আমরা সবাই মিলে এই নিষ্পাপ দরিদ্র কিশোর-তরুণদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছি।
উত্তরাঞ্চলে মঙ্গা নেই বলে সরকার উচ্চকণ্ঠে প্রচার করছে। মঙ্গা মানে ক্ষুধা। মঙ্গা মানে কাজের অভাব। উত্তরাঞ্চল এখনো দেশের সবচেয়ে দারিদ্র্যপ্রবণ এলাকা। এখানে শিক্ষার হার কম। কাজের সুযোগ আরও কম। এ কারণেই ওই ১০ শিক্ষার্থী জলঢাকা থেকে কুমিল্লায় গিয়েছিল ইটভাটায় কাজ করতে। ফিরে এল লাশ হয়ে।
এই মৃত্যু আমাদের সম্মিলিত ব্যর্থতা ও দায়িত্বহীনতার ফল। ইটভাটার মালিকের দায়িত্ব ছিল, সেখানে যঁারা কাজ করেন, তঁাদের জন্য থাকার ঘর তৈরি করে দেওয়া। কিন্তু তিনি সেটি না করে রাস্তার পাশে অস্থায়ী ও নড়বড়ে ছাউনি করে দিয়েছেন। সারা দিনের পরিশ্রম শেষে শ্রমিকেরা সেখানেই ঘুমিয়ে পড়েন, সেখানেই তঁাদের খাওয়াদাওয়া করতে হয়। মালিকের দ্বিতীয় কর্তব্য ছিল, তাঁর ইটভাটায় যে কয়লাভর্তি ট্রাক আসে, সেই ট্রাক থেকে নিরাপদে কয়লা নামানোর ব্যবস্থা করা। তিনি সেটাও করেননি। ফলে কয়লা খালাস করতে গিয়ে ট্রাকটি পেছনের দিকে যেতেই উল্টে রাস্তার পাশের ছাউনির ওপর পড়ে। আর তাতে ১০ শিক্ষার্থীসহ ১৩ জন শ্রমিক ঘুমন্ত অবস্থায়ই মারা যান।
ইটভাটার এই নিষ্পাপ কিশোর–তরুণদের মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে তোলে। ইটভাটার মালিক, ট্রাকের মালিক–চালকের পাশাপাশি এই রাষ্ট্র ও সমাজকেও আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করায়।
দুর্ঘটনায় মৃত্যু না হলে হয়তো আমরা এই ১০ স্কুলছাত্র যে ইটভাটায় কাজ করে পড়াশোনার খরচ জোগাড় করত, সেই সত্যটি জানতে পারতাম না। শুধু জলঢাকার ১০ শিক্ষার্থী নয়, সারা দেশে হাজার হাজার কিশোর-তরুণ পড়াশোনা চালাতে গিয়ে এ রকম বা এর চেয়েও বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু সরকার উন্নয়নের যে রোলমডেল করেছে, বার্ষিক বা পঞ্চবার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে, তাতে এই শ্রমজীবী কিশোর শিক্ষার্থীদের কোনো জায়গা নেই। সরকার যে সারা দেশে দরিদ্র মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীতে নিয়ে আসার জন্য কোটি কোটি টাকার কর্মসূচি নিয়েছে, তাতেও এদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। সরকার যে ১০০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচি নিয়েছিল, এই কিশোর-শিক্ষার্থীরা তারও বাইরে ছিল।
তাহলে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কত বাড়ল, বাজেটের আকার চার লাখ কোটি না পাঁচ লাখ কোটি টাকা হলো, তাতে এই মূঢ় ম্লান মানুষগুলোর কী আসে-যায়। সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির গুড় যে সব পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলে, পত্রিকার পাতা খুললেই দেখতে পাই। সংসদে বিরোধী দলের উপনেতা গোলাম মোহাম্মদ কাদের বলেছেন, এরশাদের আমলের চেয়ে দুর্নীতি এখন বেশি হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআই) প্রতিবেদন নিয়ে সরকারের মন্ত্রী ও দুদক চেয়ারম্যান প্রতিবাদ করলেও উপনেতার বক্তব্যের প্রতিবাদ করেননি। টিআইয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুর্নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার ৮টি দেশের মধ্যে নিচের দিক থেকে সপ্তমে। এমনকি ‘মহাদুর্নীতিগ্রস্ত দেশ’ পাকিস্তানও আমাদের চেয়ে ভালো অবস্থানে আছে।
শিক্ষার হার নিয়ে আমাদের নীতিনির্ধারকেরা বড়াই করেন। প্রবৃদ্ধির হার ৭ শতাংশে উন্নীত করা এবং দারিদ্র্যের হার ২২ শতাংশে কমিয়ে আনতে পারায় তাঁরা আহ্লাদিত। কিন্তু দশম শ্রেণির ছাত্রকে যখন জীবিকার জন্য ইটভাটায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতে হয়, তখন আমাদের উন্নয়ন কৌশলের ফাঁকিটা আর আড়াল করা যায় না। সত্যিকার উন্নয়ন হলে তার সুবিধা সমাজের প্রান্তিক মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা। কিন্তু সরকারের উন্নয়ননীতিটা হলো ধনীকে আরও ধনী করো। তেলা মাথা তেল দাও। সমাজে যে কোটি কোটি বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষ আছে, তাদের প্রতি তেমন নজর দেয় না।
বিবিএসের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে ২০০৯ সালে পাঁচ কোটি মানুষ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করত, তাদের মধ্যে প্রায় তিন কোটি মানুষ ছিল চরম দরিদ্র অবস্থায়। এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে পৌনে চার কোটি মানুষ। আর চরম দারিদ্র্যে আছে দেড় কোটির কিছু বেশি মানুষ। এই তথ্য সরকারের। এই ধারায় দারিদ্র্য কমলে ১০০ বছর লাগবে দারিদ্র্যমুক্ত হতে। জনসংখ্যার প্রায় এক–চতুর্থাংশকে মৌলিক ও মানবিক সব অধিকারের বাইরে রেখে উন্নয়নের রোলমডেল হওয়ার দাবি হাস্যকরই বটে।
শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে একটি শিশু-কিশোরকেও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। আমরা যদি স্বীকার করি শিক্ষা মৌলিক অধিকার, তাহলে দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীকে কোনোভাবে ইটভাটা কিংবা আরও কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে পাঠাতে পারি না। প্রথম আলোয় অদম্য মেধাবীদের যেসব জীবনকাহিনি প্রকাশিত হয়েছে, তাতে তাদের দুঃখ–কষ্ট ও সংগ্রামের কিছু কিছু চিত্র উঠে এসেছে। কিন্তু যারা অতটা মেধাবী নয়, তাদের জীবনকাহিনি অজানাই থেকে যায়।
রাষ্ট্র যাঁরা পরিচালনা করেন, সমাজের যঁারা অধিপতি হয়ে বসে আছেন, তাঁরা এই দারিদ্র্যপীড়িত ও নিরুপায় মানুষগুলোর খবর রাখেন না। জীবিত থাকতে এসব মানুষ খবরের শিরোনাম হয় না। শিরোনাম হয় মৃত্যুর পর।
সরকারের উন্নয়নের বয়ানের সঙ্গে জলঢাকার ১০ কিশোরের জীবনকাহিনি ও মৃত্যু কোনোভাবে মেলে না। মৃত্যুর পর সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিটি পরিবারকে এক লাখ টাকা এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জীবিত থাকতে এরা আমাদের সদাশয় সরকার, সেবাপরায়ণ প্রশাসন ও জনদরদি জনপ্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। আমাদের সমাজ এতটাই বিবেকহীন।
সরকার মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীকে বিনা মূল্য বই দিচ্ছে। মেয়েশিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দিচ্ছে, এগুলো ভালো কাজ। কিন্তু সরকার কেন মাধ্যমিক পর্যন্ত সব শিক্ষার্থীর পড়াশোনার দায়িত্ব নেবে না? বিশেষ করে, দারিদ্র্যের কারণে যেসব অভিভাবক সন্তানের পড়াশোনার খরচ জোগাতে অক্ষম, তাঁদের পাশে দাঁড়াবে না?
আমরা মনে করি, কোটি কোটি টাকা খরচ করে নতুন নতুন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও বিভাগ খোলার চেয়ে স্কুল পর্যায়ে সব ছেলেমেয়ের শিক্ষা নিশ্চিত করা সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত। আর কোনো শিক্ষার্থীকে যাতে ইটভাটায় কাজ করতে গিয়ে জীবন দিতে না হয়, সেই িনশ্চয়তাও তাকে দিতে হবে।
সোহরাব হাসান : প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি