প্রিয়াঙ্কা কি ইন্দিরা হতে পারবেন?
চমকের রাজনীতিতে নতুন ধামাকা প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রার আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে যোগদান। কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট ভাই রাহুল দিদি প্রিয়াঙ্কাকে মানিয়ে-বুঝিয়ে রাজি করিয়েছেন, পাশে দাঁড়ানোর এটাই মোক্ষম সময়। প্রিয়াঙ্কা এখন কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। দিল্লির মসনদে ফেরার চাবি সব সময় উত্তর প্রদেশের হাতে থাকে, এক উত্তর প্রদেশ থেকেই আসেন ৮০ জন সাংসদ। লোকসভা সরগরম রাখেন তাঁরাই। উত্তর প্রদেশের ভোটে হেরে এখন পর্যন্ত কেউ দিল্লির মসনদ বগলদাবা করতে পারেননি। গত লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেস উত্তর প্রদেশ থেকে প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। মা সোনিয়া আর বেটা রাহুল ছাড়া কেউ কোনো আসন পাননি সেই রাজ্যে। অনেকেই মনে করেন, এই দুই আসনে কংগ্রেস দল বা প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা নয়, বরং প্রিয়াঙ্কার ক্যানভাস সবচেয়ে বেশি কাজ করেছিল। প্রিয়াঙ্কার একটা কথা সে সময় মানুষের মুখে মুখে ঘুরত, ‘জনসেবা করতে মানুষের পাশে দাঁড়াতে ৫৬ ইঞ্চি বুকের পাটা লাগে না, লাগে হৃদয়, সাগরের মতো বিশাল হৃদয়।’ সোনিয়ার বিপক্ষে নানা অপপ্রচারের বিরুদ্ধে এটাই ছিল মেয়ে প্রিয়াঙ্কার মোক্ষম জবাব।
গুজরাটের মোদি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য লোকসভার নির্বাচন করেছিলেন উত্তর প্রদেশ থেকে, পরে বিধানসভার নির্বাচনে দলের পক্ষে প্রচারে গিয়ে প্রিয়াঙ্কা বলেছিলেন, ‘উত্তর প্রদেশে কি মানুষ নেই যে আমাদের বাইরে থেকে দত্তক নিতে হবে? উত্তর প্রদেশের মাটিতে বড় হওয়া নওজোয়ানেরাই এখানকার উন্নয়নের জন্য কি যথেষ্ট নয়?’ জনসভায় মানুষ যা শুনতে চায়, প্রিয়াঙ্কা তা শোনাতে পারেন। দাদি ইন্দিরার এই গুণটা বিলক্ষণ তাঁরও আছে। বিধানসভার ভোটে কংগ্রেস তার সঙ্গী-দলগুলো নিয়ে সুবিধা করতে পারেনি, কিন্তু প্রিয়াঙ্কা যাওয়া-আসা বন্ধ করেননি। এটাও ইন্দিরা ঘরানার রাজনীতি—যে ফিরিয়ে দিয়েছে, তাকেও তিনি টেনে ধরতেন। জরুরি অবস্থা জারি করে সব জনপ্রিয়তা হারিয়ে ১৯৭৭ সালে ইন্দিরা যখন গদিহারা, যখন মামলার পর মামলা খেতে খেতে জান খারাপ, তখন তিনি ছুটে গিয়েছেন বিহারের দুর্গম জনপদ বেলচিতে।
বেলচির নাম এর আগে তেমন কেউ শোনেনি। জায়গাটি আলোচিত হয় একটা সহিংসতার ঘটনায়। উচ্চবর্ণের লোকজন ভোটে জেতার মৌতাতে দলিতদের গ্রাম বেলচি আক্রমণ করে বসে। জমি-জায়গা নিয়ে তাদের সঙ্গে পুরোনো ঝামেলা ছিল। এক দিনে সব ঝামেলা মিটিয়ে দিতে ১১ জনকে দলিতকে হাত-পা বেঁধে গুলি করার পর একজন একজন করে আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়। তারপর পুড়ে যাওয়া গ্রাম তছনছ করে চলে যায় তারা। দেশভাগের পর থেকে দলিত হরিজনেরা সব সময় কংগ্রেসকে ভোট দিয়েছে। জরুরি অবস্থার বাড়াবাড়ি, বিশেষ করে জোর করে জন্মনিয়ন্ত্রণের স্থায়ী ব্যবস্থা (যা সে সময় নাশবন্দি হিসেবে কুখ্যাতি লাভ করে) চাপিয়ে দেওয়া ছাড়াও নানা জোর-জুলুম আর ধরপাকড়ে অতিষ্ঠ দলিত হরিজনেরা কংগ্রেসের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নেয়। বিহার আর উত্তর প্রদেশের হরিজন বেল্টেও কংগ্রেসের ভরাডুবি হয়। এই পরিস্থিতিতে ক্ষমতাচ্যুত ইন্দিরার বেলচি সফর পরিণত হয় ক্ষমতা উদ্ধারের অভিযানে। তখনকার প্রখ্যাত সাংবাদিক জনার্দন ঠাকুর সেভাবেই বর্ণনা করেছিলেন ইন্দিরার রাতবিরাতে হেঁটে হাওদা ছাড়া হাতির পিঠে চড়ে বৃষ্টিতে ভিজে বেলচির বিধবাদের কাছে ছুটে যাওয়ার কাহিনি।
সেই দুর্দিনে ইন্দিরার বয়স তখন ছিল ৬০, আর প্রিয়াঙ্কার এখন মাত্র ৪৭। দাদির মতো মওকা বুঝে ছোটাছুটির রাজনৈতিক ঝোঁক তাঁরও আছে। আর আছে মানুষকে কাছে টানার ক্ষমতা। এটাই বিজেপির ভয়ের কারণ। নরেন্দ্র মোদি আর উত্তর প্রদেশের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের ক্ষমতার দুর্গ বলে পরিচিত রাজ্যের পূর্বাঞ্চলের দায়িত্ব পেয়েছেন প্রিয়াঙ্কা। রাহুল বলেছেন, এই দায়িত্ব দুই মাসের জন্য নয় শুধু, নির্বাচনে প্রচারের জন্য কুইক রেন্টালে তাঁকে আনা হয়নি।
প্রিয়াঙ্কার আনুষ্ঠানিক পদে যোগদান নিয়ে মন্তব্য-টিপ্পনী চলছে। প্রথমে বিজেপি বলেছিল, ওসব নিয়ে আমাদের ভাবার সময় নেই। রাজনীতি-অর্থনীতির অনেক বিষয় আছে, যা প্রিয়াঙ্কার চেয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। মেঠো বক্তৃতার মতো কথাবার্তা বলেও তারা মনের আসল ভাব গোপন করতে পারেনি। পরিবারতন্ত্র, নিজে পারছে না তাই দিদিকে টানছে, কংগ্রেসে হাল ধরার লোক নেই, মেয়ে-মায়ে-পুতের সংসার ইত্যাদি ইত্যাদি বলে বিষোদ্গার করা হচ্ছে।
কংগ্রেস বাদে গড়ে তোলা বিজেপিবিরোধী মোর্চার আখিলেশ-মায়াবতীর ভাতঘুমেও চিড় ধরিয়েছে প্রিয়াঙ্কা কার্ড। তাঁদের নতুন করে কষতে হবে ভোটের অঙ্ক।
তবে প্রিয়াঙ্কাকে আটকাতে উপমহাদেশের রাজনীতির নোংরা কিন্তু কার্যকর পথ মামলা-হামলার পথে হাঁটতে কসুর করবে না বিজেপি। আদালত, পুলিশ, গোয়েন্দা, সামাজিক মাধ্যমের অসামাজিক প্রচার আর পোষা গণমাধ্যমের অপপ্রচার—সবকিছুই এস্তেমাল করবে ক্ষমতাসীন দল। প্রিয়াঙ্কার স্বামী রবার্টের চটজলদি মহা ধনী হয়ে ওঠার রহস্য উন্মোচনে ক্রমে মরিয়া হয়ে উঠবে তারা। এই লেখার মুসাবিদা তৈরির সময় হরিয়ানায় সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র সিংহ হুডার বাড়িতে সিবিআই তল্লাশির খবর রাষ্ট্র হয়ে গেছে। সিবিআই একসঙ্গে দিল্লির নানা অফিস আর বাড়ি মিলিয়ে কমপক্ষে ৩০টি জায়গায় অভিযান চালিয়ে প্রচুর নথিপত্র জব্দ করেছে। হুডার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০৫ সালে মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালকে কয়েক কোটি টাকার জমি মাত্র ৫৯ লাখ টাকায় বেআইনিভাবে পুনর্বণ্টন করেন তিনি। ন্যাশনাল হেরাল্ডের অধীন অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালের পরিচালন বোর্ডের সদস্যদের মধ্যে অন্যতম কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ও সোনিয়া গান্ধী। এটা কারও অজানা নয় যে কথিত জমি অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালকে প্রথম দেওয়া হয় ১৯৮২ সালে। তারপর দিল্লি-হরিয়ানায় কংগ্রেসের পতন হলে ১৯৯৬ সালে সেই জমি অ্যাসোসিয়েটেড জার্নালের কাছ থেকে ফিরিয়ে নেয় হরিয়ানা সরকার। এরপর ভূপেন্দ্র সিং হুডা মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর ফের সেই জমি দেওয়া হয় ওই সংস্থাকে। খালি চোখে মনে হবে, এটা রবার্টের শালা-শাশুড়ির মামলা।
গত সেপ্টেম্বরে রবার্ট আর হুডাকে জড়িয়ে হরিয়ানার গুরগাঁও থানায় একটা মামলা করা হয়। মামলার বিবরণে বলা হয়, রবার্টের স্কাইলাইট হসপিটালিটি প্রাইভেট লিমিটেড ২০০৮ সালে ওঙ্কেশর প্রোপার্টির কাছ থেকে মাত্র সাড়ে সাত কোটি রুপি দিয়ে ৩ দশমিক ৫ একর জমি কেনে। সে সময় মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে হরিয়ানার নগর ও গ্রাম পরিকল্পনা দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন হুডা। সিবিআই এই অনিয়মের বিহিত করতে চায়। এক ঢিলে যত পাখি মারা যায়।
লেখক: গবেষক