জার্মানিতে ১৫ জানুয়ারি পালিত হলো রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিয়েবনেক্টের মৃত্যুর শততম বার্ষিকী। মৃত্যুর শত বছর পরও জার্মানিতে তাঁরা
শ্রদ্ধার পাত্র। ১০০ বছর আগে ১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারিতে জার্মানি তথা বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির লড়াইয়ের এই দুই পুরোধা ব্যক্তিত্বকে ভাইমার প্রজাতন্ত্রের স্বেচ্ছাসেবী সৈনিকেরা বার্লিনে গুলি করে হত্যা করেছিলেন। এই দুই দেশপ্রেমিক রাজনীতিক এখনো বিশ্বজুড়ে সমুজ্জ্বল।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে জার্মানির জনগণ তখন যুদ্ধক্লান্ত। ১৯১৮ সালে বছরের শেষ পর্যায়ে যে বিপর্যয় এসেছিল, তা জার্মানির জনগণের কাছে ছিল একেবারেই অপ্রত্যাশিত। যুদ্ধে ক্রমাগত পরাজয় আর বিপর্যয় দেখে তারা অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। ১৯১৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হওয়া প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছিল ১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে। জার্মানি তার সমুদ্রপাড়ের অধিকাংশ রাজ্য হারিয়েছিল। যুদ্ধে বিজয়ী মিত্রপক্ষের অর্থ–সম্পদের দাবির মুখে জার্মানির গুরুত্বপূর্ণ কয়লা ও ইস্পাতখনির মালিকানা দিয়ে দেওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছিল।
১৯১৮ সালের নভেম্বর মাসে যুদ্ধবিরোধী চুক্তি শেষ হওয়ার দুই সপ্তাহ আগেই জার্মানির শ্রমিক, নাবিক ও সৈন্যরা জার্মানির সম্রাট ও অভিজাত শ্রেণির বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু করেছিলেন। উত্তর জার্মানির ভিলেমসহাভেন বন্দরে শুরু হওয়া বিপ্লব ব্রিটেন, হামবুর্গ ও কিল বন্দরে ছড়িয়ে পড়েছিল। শ্রমিক, নাবিকেরা বন্দরগুলোয় লাল ঝান্ডা উত্তোলন করলেন। এই বিপ্লবের ঢেউ এসে লাগল রাজধানী বার্লিনে। ১৯১৮ সালের ৯ নভেম্বর জার্মান বা প্রুশিয়া রাজতন্ত্রের পতন হলে সম্রাট ফ্রিডরিশ ভিলহেলম ভিক্টর আলবার্ট বা কাইজার ভিলহেলম সিংহাসন ও নিজ রাজ্য ছেড়ে হল্যান্ডে চলে যান।
যুদ্ধোত্তর জার্মানি ও প্রুশিয়া রাজ্যের তখন হাল ধরেন জার্মানির সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা ফ্রিডরিশ এর্বাট। সেই সময় ফ্রিডরিশ এর্বাটের সামাজিক গণতান্ত্রিক দলটিতে ডান ও বামপন্থীদের সমন্বয় ছিল। তবে দলে ডানপন্থীদের প্রভাবই ছিল বেশি, তারা পার্লামেন্টারি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আর বামপন্থী সমর্থকেরা চেয়েছিল শ্রমিকশ্রেণির প্রত্যক্ষ শাসন। এর বাইরে ছিল জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি, তাদের নেতা ছিলেন কার্ল লিয়েবনেক্ট আর রোজা লুক্সেমবার্গ ছিলেন সবচেয়ে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন প্রভাবশালী নেত্রী। জার্মান কমিউনিস্ট পার্টি সেই সময় পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের পথে না হেঁটে শ্রমিকশ্রেণির জন্য অধিক ক্ষমতা ও মূলধনওয়ালা পুঁজিপতিদের উচ্ছেদ করতে চেয়েছিলেন। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্র না বিপ্লবী সরকার সেই প্রশ্নে উভয় পক্ষ মীমাংসার চেষ্টা করলেও আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিশৃঙ্খল জার্মানিতে সম্রাট বা কাইজার ফ্রিডরিশ ভিলহেলম অপসৃত হলেও পুরোনো সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বিরাজমান ছিল। তবে নবগঠিত ভাইমার রিপাবলিকের যুদ্ধোত্তর দেশ গঠনে কিছু সময়েরও প্রয়োজন ছিল বলে ঐতিহাসিকেরা মনে করেন।
কথা ছিল ১৯১৯ সালের ১৯ জানুয়ারি জার্মানির সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের। নির্বাচনের আগেই ৬ জানুয়ারি কার্ল লিয়েবনেক্টের নেতৃত্বে জার্মানি কমিউনিস্ট পার্টি ক্ষমতা গ্রহণের উদ্দেশ্যে সদ্য ক্ষমতাসীন জার্মানির সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতা ফ্রিডরিশ এর্বাটের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। বিদ্রোহীরা বার্লিনে বেশ কিছু সরকারি অফিস ও সংবাদপত্রের অফিস দখল করে নেন। সামাজিক গণতান্ত্রিক সরকার সাবেক রাজতন্ত্রের রক্ষণশীল সেনাবাহিনীর সহায়তায় বিপ্লব দমন করে। ১২ জানুয়ারি বিপ্লব দমনের পর সেনাবাহিনী রাজধানী বার্লিনে বিপ্লবীদের সমর্থক ও সামাজিক গণতান্ত্রিক দলে থাকা বামপন্থীদের ওপর চড়াও হয়েছিল। রাজতন্ত্রের রক্ষণশীল সেনাবাহিনী এই বিদ্রোহের পর হাজার হাজার শ্রমিককে হত্যা করেছিল।
১৯১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি বার্লিনের ভিলমার্সডর্ফ এলাকার একটি বাড়ি থেকে সৈন্যরা কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়াই রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিয়েবনেক্টকে ধরে জেলখানায় না নিয়ে বার্লিনের হোটেল ইডেনে নিয়ে আসেন। এই হোটেলে তাঁদের উভয়কেই জেরা করা হয়। সম্ভবত সেখানেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধফেরত রক্ষণশীল স্বেচ্ছাসেবী সৈন্যরা উভয়কে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এরপর কার্ল লিয়েবনেক্টকে বার্লিন শহরের কেন্দ্র টিয়ারগার্টেন এলাকায় হত্যা করা হয় আর রোজা লুক্সেমবার্গকেও হত্যা করে বার্লিনের একটি খালে ফেলে দেওয়া হয়।
রোজা লুক্সেমবার্গের জন্ম ১৮৭১ সালে পোল্যান্ডে জামচেক শহরে। পুরো নাম রোজালিয়া লুক্সেমবার্গ। ওয়ারশতে শহরে স্কুলে পড়াশোনাকালীন গোপন দ্বিতীয় প্রলেতারিয়েত সংগঠনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। পুলিশি হামলার মুখে পালিয়ে আশ্রয় নেন সুইজারল্যান্ডে। সেখানকার জুরিখে তিনি আইন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি শ্রমিকবিষয়ক একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন। তিনি প্রথমে জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্র দলে যোগ দিলেও পরে ১৯১৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। তাঁর রাজনীতি ছিল সব সময় শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে আর পুঁজিবাদ ও রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে।
কার্ল লিয়েবনেক্টের জন্ম ১৮৭১ সালে লাইপজিগ শহরে। তাঁর বাবা অগ্যস্ট বিবেল ছিলেন জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্র দলের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি লাইপজিগ ও বার্লিনে আইন ও রাষ্ট্র প্রশাসন বিষয়ে পড়াশোনা করেন। তিনি আইন ব্যবসার পাশাপাশি সোশ্যালিস্ট ইয়ুথ ইন্টারন্যাশনাল নামের সমাজতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক কার্যক্রমের জন্য ১৯০৭ সালে তাঁকে জেলে যেতে হয়। তিনি ছিলেন একাধারে মেধাবী সংগঠক ও তাত্ত্বিক।
রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিয়েবনেক্টের নেতৃত্বেই জার্মানিতে বামপন্থী দলের সূচনা হয়েছিল, তাঁদের হাতে তৈরি স্পার্টাকাস লিগ থেকেই ১৯১৮ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির যাত্রা শুরু হয়। শত বছর আগে শ্রমিকশ্রেণির মুক্তির সংগ্রামে রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিয়েবনেক্টের বিপ্লব ব্যর্থ হলেও তাঁদের পথ ধরে জার্মানির শ্রমিক সংগঠন ও আন্দোলনের ঐতিহ্য এখনো রয়েছে। জার্মানির প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো শ্রমিক সংগঠন ও তাদের বিশাল সদস্যসংখ্যা বিশ্বের যেকোনো শ্রমিক সংগঠনের কাছে ঈর্ষণীয়। শ্রমিকদের বেতনকাঠামো, কাজের সময়, চাকরি বিমা, অসুস্থতা, ছাঁটাই ইত্যাদি বিষয়ে জার্মান শ্রমিকদের রয়েছে অনুকূল শ্রমসংক্রান্ত পরিবেশ। আর এই পরিস্থিতি–পরিবেশ এক দিনে হয়নি, এর পেছনে রয়েছে রোজা লুক্সেমবার্গ ও কার্ল লিয়েবনেক্টদের মতো মানুষের বহু তিতিক্ষা ও শ্রমিকশ্রেণির জন্য সংগ্রামী আকাঙ্ক্ষা।
সরাফ আহমেদ, প্রথম আলোর হ্যানোভার (জার্মানি) প্রতিনিধি
[email protected]